পাকিস্তানে ভারতের হামলায় ২৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী। হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৬ জন। তিনি আরও জানিয়েছেন, বুধবার প্রথম প্রহরে মিসাইল ছুড়েছে ভারত। এ হামলায় পাকিস্তানে নিহত বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে আর আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৬ জন। ভারত সরকার দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানের নয়টি জায়গায় হামলা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনো সামরিক স্থাপনা তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল না। পহেলগামের ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে ভারত। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এ সময় ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।
দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে পাকিস্তান বলেছে, ভারত পাঁচটি স্থানে হামলা হয়েছে। গতকাল বার্তা সংস্থা এএফপি’র অনলাইন প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান দাবি করেছে, দেশটি ভারতের অন্তত পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে ভারতীয় সেনাদের হামলায় ৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর তারা পাল্টা জবাব দিয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাশ্মীরে তিন জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ভারতের যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে অন্তত পাঁচটি ভূপাতিত করা হয়েছে। এসব হামলায় ৯ জন নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক মিডিয়া উইং। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রতিবেশী দুই দেশের যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া উভয় দেশের জন্যই দুঃখজনক। তিনি বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করে যুদ্ধ এড়ানো যেত।
পাকিস্তানে জরুরি বৈঠক : ভারতের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে ৯ জন নিহত হওয়ার পর দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সকালে জরুরি বৈঠকে বসছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শুরু হতে যাওয়া এই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফসহ নিরাপত্তা খাত সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া এই খবর জানায়। সামরিক মিডিয়ায় লাইভে সম্প্রচারিত খবরে জানানো হয়েছে, ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এরআগে ভারত একযোগে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। দিল্লি দাবি করেছে, জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়ায় তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। পাকিস্তান ভারতীয় হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। ইসলামাবাদ বলেছে, সময় ও স্থান বেছে এই হামলার ‘উপযুক্ত’ জবাব দেওয়া হবে। গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যায়। সীমান্তে প্রতিদিনই চলছে গুলিবিনিময় এবং উভয় দেশ বিভিন্ন কৌশলগত ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
পাকিস্তানে যেসব স্থানে হামলা : দুই সপ্তাহ আগে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলার জবাবে পাকিস্তানে চালানো বিমান হামলায় নয়টি ‘জঙ্গি ঘাঁটি’ ধ্বংস করার দাবি করেছে ভারত। দেশটির দাবি, এগুলো ছিল জঙ্গিদের ব্রেনওয়াশ, প্রশিক্ষণ ও অভিযান চালানোর ঘাঁটি। তবে পাকিস্তান বলছে, ছয়টি স্থানে আঘাত হানা হলেও সেগুলো কোনও জঙ্গি ঘাঁটি ছিল না। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে ভারত যেসব স্থাপনাকে নিশানা করেছে সেগুলোর কথা তুলে ধরেছে।
মারকাজ তাইবা ক্যাম্প : ভারতের দাবি, নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই ক্যাম্প ছিল লস্কর-ই-তইয়্যেবার সদর দফতর। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার একমাত্র জীবিত অভিযুক্ত আজমল কাসাব এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সেই হামলায় ১৬০ জনের বেশি নিহত হয়েছিলেন।
মারকাজ সুবহান ক্যাম্প : সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিমি ভেতরে থাকা এই ক্যাম্পটি জইশ-ই-মোহাম্মদের সদর দফতর ছিল বলে ভারতের দাবি। এখানে সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থায় দীক্ষা দেওয়া হতো।
মেহমুনা জয়া ক্যাম্প : ভারতের দাবি, সীমান্ত থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরের এই ক্যাম্পটি ছিল হিজবুল মুজাহিদীনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখান থেকেই ২০১৬ সালে ভারতের একটি বিমান ঘাঁটিতে চালানো হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়, যাতে সাত জন নিহত হয়।
গুলপুর ক্যাম্প : সীমান্ত থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত এই ঘাঁটি ছিল লস্কর-ই-তৈয়্যবার অন্যতম ঘাঁটি। ভারত বলছে, গত জুনে জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৯ জনকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে এখানকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাকিউর রহমান লখভি এই ঘাঁটিতে নিয়মিত দীক্ষা ও বক্তৃতা দিতেন।
সারজাল ক্যাম্প : ভারতের দাবি, মার্চ মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে চার জন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনার জঙ্গিরা এই ক্যাম্প থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিযান চালায়। ক্যাম্পটি সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ কিমি. ভেতরে অবস্থিত।
আব্বাস ক্যাম্প : এই ক্যাম্পকে লস্কর-ই-তৈয়্যবার আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের ‘নার্ভ সেন্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ভারত। এটি সীমান্ত থেকে ১৩ কিমি. দূরে অবস্থিত।
সাইয়্যেদনা বেলাল ক্যাম্প : ভারতের মতে, এটি ছিল জইশ-ই-মুহাম্মদের অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। একই সঙ্গে এই ক্যাম্পে কাশ্মীরে টিকে থাকার কৌশল শেখানো হতো।
সওয়াই নালা ক্যাম্প : সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিমি. দূরে অবস্থিত এই ক্যাম্পটিকে লস্কর-ই-তৈয়্যবার অন্যতম প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছে ভারত।
বারনালা ক্যাম্প : ভারতের দাবি, এই ক্যাম্পে অস্ত্র পরিচালনা, বোমা তৈরির কৌশল এবং জঙ্গলে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া : পাকিস্তান বলছে, ভারত যেসব স্থানে হামলা চালিয়েছে সেগুলোতে কোনও জঙ্গি উপস্থিত ছিল না এবং তারা যথাযথ জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে। তবে এখনও সরাসরি কোনও পাল্টা হামলা চালানো হয়নি।
উল্লেখ্য, গত মাসে কাশ্মীরের পহেলগামে এক হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানের মদত রয়েছে বলে দাবি করেছে। এরপর থেকেই দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।-এফএনএস