শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘আদিবাসীদের’ মাতৃভাষার কী হবে?

Paris
Update : মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

দেশের জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা টিকিয়ে রাখার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকার পাহাড়ের মতো সমতলের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই সরবরাহ করলেও তা পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক স্কুলগুলোতে নেই। ফলে বই হাতে পেয়েও মায়ের ভাষায় পড়তে-শিখতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে এসব নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর। উত্তরাঞ্চলের নাটোর জেলায় সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহান, মুন্ডা, গানঝো, মাহাতি, বাগদি, তেলি, মুশাহ, ভুঁইয়াসহ ১০ থেকে ১২টি জাতিগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২২ হাজার মানুষ বসবাস করেন। এদের সবার নিজস্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সদর উপজেলায় বসবাসকারীদের একটি বড় অংশের বাস শংকর ভাগ ‘আদিবাসী পল্লী’তে। এখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা পড়শোনা করে স্থানীয় চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।-এফএনএস

গত বছর এসব বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থীকে ‘সাদরি’ ভাষায় লেখা পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হলেও কোনো শিক্ষক না থাকায় সেসব বইয়ের পাতা উল্টানোই সার হয়েছে শিক্ষার্থীদের। মাতৃভাষায় পড়া তো দূরের কথা; শেখার সুযোগও হচ্ছে না তাদের। আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় এবার সেখানে মাত্র কয়েক সেট বইয়ের চাহিদা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়। শংকর ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শারমিন খন্দকার বলেন, “বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর বেশিরভাগ বাচ্চা এই স্কুলে পড়ালেখা করে। তারা বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া করে। আমরা তাদের মাতৃভাষাটা শিক্ষাটা দিতে পারি না; পারলে ওরা ওদের মায়ের ভাষায় পড়তে পারতো। “গত বছর সরকার সাদরি ভাষায় পাঠ্যবই দিয়েছিলো। আমরাও অনেক কিছু বুঝতাম না। এ বছর এখনও নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বইগুলো স্কুলে আসেনি। নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শেখানোর যদি কোনো শিক্ষক থাকতো তাহলে বাচ্চারা সহজেই ওদের মায়ের ভাষা শিখতে পারতো।” নাটোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গোলাম নবী বলেন, “২০২২ সালের চাহিদা অনুযায়ী, সাত উপজেলায় বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ ‘সাদরী’ ভাষার ৩৪৪ সেট বই বিতরণ করা হয়। নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার আলাদা শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা সাদরি ভাষায় শিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। “আগ্রহ কম থাকায় এ বছর মাত্র ১৬ সেট ভাষার বইয়ের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। চাহিদার হিসেবে, শুধু সাদরি ভাষার বই জেলাজুড়ে বিতরণ করা হয়েছিল। “তবে জেলাজুড়ে কতজন বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তার কোনো হিসাব নেই বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সারাদেশে সরকার চাকমা, মারমা, ককবরক (ত্রিপুরাদের ভাষা), আচিক (গারো বা মান্দিদের ভাষা) ও সাদরি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। সাঁওতালি ভাষায়ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু রোমান, বাংলা, অলচিকি- কোন হরফে সাঁওতালিদের জন্য পাঠ্যবই রচিত হবে; তা নিয়ে দ্বন্দ্বে আটকে যায় পুস্তক ছাপানোর কাজ। পাহাড়ে মূলত চাকমা, মারমা, ককবরক ভাষার পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়। সেখানেও সরকারিভাবে কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। তবে বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু উদ্যোগ আছে। এ ছাড়া এই তিন ভাষার অনেকেই নিজেদের মাতৃভাষার হরফ চেনেন, জানেন। তাদের মধ্যে যারা স্কুলে কর্মরত তারা অনায়াসেই মাতৃভাষায় নিজের গোষ্ঠীর শিশুদের কিছুটা শিক্ষা দিতে পারছেন। সমতলের অবস্থা তা থেকে একেবারেই ভিন্ন। আচিক ভাষি গারোরা মূলত বসবাস করেন ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। সাদরি প্রধানত ওঁরাওদের ভাষা হলেও উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী বেশ কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময় ও যোগাযোগের জন্য এই ভাষাটি ব্যবহার করে থাকে। ফলে সাদরি ভাষার ব্যবহার সমতলের কিছু নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে। নাটোর সদর ও নলডাঙ্গার নৃ-গোষ্ঠীর অধিকাংশই সাঁওতাল। সাঁওতালি শিক্ষার্থীরা নিজেদের মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে না, সাদরি ভাষায় বই পেলেও তাতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত বিদ্যাশিক্ষার জন্য বাংলা ভাষাই তাদের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের এত এত টাকা খরচ করে এ রকম একটি ভাল উদ্যোগ শুধু বই ছাপানোর মধ্য দিয়ে কতটুকু মাতৃভাষা শিক্ষার কাজ হচ্ছে তা নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। শংকর ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী দীঘি বলে, “আমি ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষা শিখেছি, তাই বাংলাতেই কথা বলি। মায়েরা যখন কথা বলে শুনেছি, তখনই যা দু-একটু মাতৃভাষা শিখেছি। স্কুলেও বাংলা ভাষাতেই পড়ালেখা করি, আলাদাভাবে মাতৃভাষা শেখার সুযোগ হয়নি, তাই পারি না।“ শেখেরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৃ-গোষ্ঠীর আরেক শিক্ষার্থী সাথী জানান, ছোটবেলা থেকে না শেখার কারণেই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না সে। স্কুলেও অন্যান্যের মত বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া করতে হয়। “গতবছর বই পেয়েছি। তবে আমাদের ভাষায় পড়ালেখা করানোর কোনো শিক্ষক নেই স্কুলে। তাই বই কে পড়াবে?” আট বছর ধরে শংকর ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন খাদিজা খাতুন। তিনি বলেন, “গত বছর নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় শিক্ষার বইটা আমরা পেয়েছিলাম এবং বাচ্চাদের দিয়েছিলাম। এ বছর বইটা এখনও পাইনি আমরা। তবে, আমার কাছে মনে হয়, নৃ-গোষ্ঠীর এসব শিক্ষার্থী বাংলাতেই বেশি স্বাছন্দবোধ করে। ওদের ভাষার বই পড়তে ওরা আগ্রহ দেখায় না, অভ্যস্ত না। খাদিজা খাতুন মনে করেন, “বিদ্যালয়ে নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার শিক্ষক না থাকায় ওদের মাতৃভাষা চর্চাটা হচ্ছে না। যে ভাষায় বই, সে ভাষার শিক্ষক না থাকলে পড়াবে কে? বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের কাছে মৌখিকভাবে যেটুকু শিখছে সেটুকুই। সেখানে লিখিত ভাষাটা তারা পাচ্ছে না।“ শংকর ভাগ পল্লীতে গেলে দুজন পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং একজন তরুণী জানান, বাড়িতে অধিকাংশ সময়ই তাদের সন্তানরা বাংলাতেই কথা বলে। বড়রা এখনও অনেকেই নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় ভাব আদান-প্রদান করে থাকে। কিন্তু ছোটরা সেই ভাষা অনেকক্ষেত্রে বুঝে না। পল্লীর তরুণী সেমন্তি পাহান বলেন, “যদি ভাষার শিক্ষার জন্য একজন শিক্ষক থাকত, তাহলে ছেলেমেয়েরা আমাদের ভাষাটা শিখতে পারতো। শুধু বাংলাতেই লেখাপড়ার কারণে ওদের মাতৃভাষাটা আর শিখতে পারছে না। বাড়িতেও মাতৃভাষার চর্চাটা শিশুদের মধ্যে কমে গেছে।” নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে নৃ-গোষ্ঠীর এই তরুণী বলেন, “মায়ের মুখে শুনলেও মাতৃভাষা শেখা হয়নি। আর বই-খাতায় না থাকায়, বিদ্যালয়ে চর্চার সুযোগ না থাকার কারণে নতুন করে শেখার সুযোগ হচ্ছে না। বাংলা ভাষাতেই সব হচ্ছে। এভাবেই দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা।“ শুধু স্কুল, পাঠ্যবই আর সরকারি উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে না থেকে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব আরোপ করা উচিত বলে মনে করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নাটোর জেলার সাধারণ সম্পাদক কালিদাস রায়। তিনি বলেন, “আমাদের মায়ের কাছ থেকে ভাষা শেখার পরিবেশটা তৈরি হচ্ছে না, চর্চারও অভাব থেকে যাচ্ছে। সামাজিক অনেক রীতি-রেওয়াজ ছিল, নাচ-গান ছিল, যেগুলোতে মাতৃভাষার চর্চাটা হতো, কালের পরিবর্তনে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা-ভাষির প্রভাব ও আগ্রাসন আদিবাসীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওযার আরেকটি বড় কারণ।“ “গতবছর জেলাজুড়ে শুধু সাদরি ভাষার বই বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষক নেই। শিক্ষক নিয়োগ না হলে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদেরকেই এসব ভাষা শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। এটাও একটা বিকল্প পথ হতে পারে।” নাটোর থেকে নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার শিক্ষক নিয়োগের কোনো চাহিদা দেওয়া হয়নি বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গোলাম নবী। তিনি বলেন, “কতজন নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করে সেই হিসাবটা আগে করতে হবে। তথ্য ও সংখ্যা না থাকলে শিক্ষকের চাহিদা দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কেউ আগে আমাদের জানায়নি। নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জরিপটা হয়ে গেলে শিক্ষা অধিদপ্তরে সেই মাতৃভাষার শিক্ষকের চাহিদা জানাবো আমরা।“ তথ্য না থাকলে কীভাবে স্কুলগুলোতে গতবছর ৩৪৪ সেট বই নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ এবং এ বছর ১৬ সেট বইয়ের চাহিদা দেওয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, “উপজেলাগুলোতে একটা হিসাব আছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ীই নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার বইগুলো দেওয়া হয়েছে। জেলায় সম্পূর্ণ তথ্যটা সংগৃহীত নাই। “আমি সেপ্টেম্বরেই নাটোরে যোগ দিয়েছি। একটি মনিটরিং টিম গঠন করে প্রাথমিক পর্যায়ে নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করবো।” সমতলের মতো একই সমস্যায় রয়েছে নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত পাহাড়ি তিন জেলাও। সেখানে চাকমা, মারমা, ককবরক ভাষায় শিক্ষার্থীরা বই পাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক না থাকায় এবং সেই বই পড়ানোর জন্য কোনো সরকারি নির্দেশনা না থাকায় সরকারের এই উদ্যোগ কতোটা বাস্তবায়ন হচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মানিকছড়ি হ্যাডম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিভা ত্রিপুরা বলেন, তার স্কুলে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা তিন ভাষাভাষি শিক্ষার্থী রয়েছে। তিনি মাতৃভাষা জানেন, ফলে শিক্ষার্থীদের সেই ভাষাটা শিক্ষা দিতে পারেন। চাকমা শিশুদেরও কিছুটা সহায়তা করতে পারেন। সরকারিভাবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের তিন মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হলেও এগুলো পড়ানোর জন্য আলাদাভাবে কোনো শিক্ষক নেই এবং এসব পাঠ্যপুস্তক স্কুলের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে পড়ানো হবে সে ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা নেই বলে জানান এই শিক্ষক। প্রতিভা বলেন, “পাহাড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষককে শিশুদের মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য নিয়োগ দিয়েছিল। তিনি বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে পড়াতেন। এ ছাড়া কোভিডের সময় আমরা অনলাইনে শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দিয়েছি।” তবে তিনি মনে করেন, সরকারের মাতৃভাষায় শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়ানোর পদক্ষেপকে বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তা নাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো বিফলে যাবে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিভা ত্রিপুরা আরও বলেন, “শিশুদের কিন্তু মাতৃভাষায় পড়াশোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহ আছে। বইগুলো তো খুব সুন্দর, ছবি আছে, গল্প আছে। সে কারণে তারা মাতৃভাষায় পড়তে আনন্দ পায়। ঘরেও তো তারা বাবা-মায়ের কাছে এই ভাষাটা শুনে থাকে। ভাষা চর্চার জন্য এটা খুবই ভাল উদ্যোগ, এর কোনো বিকল্প নেই।”


আরোও অন্যান্য খবর
Paris