শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাল্যবিবাহে ঝরে পড়ছে অসংখ্য শিক্ষার্থী

Paris
Update : সোমবার, ৪ অক্টোবর, ২০২১

এফএনএস : বাংলাদেশে করোনা মহামারির সময় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়া বেড়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে মোট ঝরে পড়া স্কুলছাত্রীর সংখ্যা কত তা নিয়ে এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো জরিপ হয়নি। গত বছরের মার্চ থেকে টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোলার পরও অনেক ছাত্রী স্কুলে নিয়মিত আসছে না বলে নজরে আসে শিক্ষকদের। এরও আগে অনেক ছাত্রী নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিচ্ছিল না। শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া অনেক ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে গেছে।

প্রধানত করোনাকালে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। বাল্যবিয়ের কারণে কী পরিমাণ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়েছে সে সংখ্যা জানা না গেলেও কিছু বেসরকারি সংস্থা বলছে করোনার সময়ে দেশজুড়েই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ের ঘটনা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে। গত ২৫ বছরে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।

এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ। তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও দেশে বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ, সমন্বয় ও সচেতনতা সৃষ্টি শাখা অনলাইনে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসংক্রান্ত এক কর্মশালাতে এমন উদ্বেগের কথা উঠে আসে। কর্মশালায় অধিদপ্তরের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অংশ নেন। কর্মশালায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, অনেক সময় ঘরের ভেতরে হওয়া এসব বিয়ের খবর পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে।

এদিকে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে। সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহের তথ্য পেয়েছে তারা। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট ২১ জেলায় জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাসের মতে, ‘এই বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে আমরা যা জেনেছি তার মধ্যে রয়েছে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিরাপত্তা সংকট, অভিভাবকদের কাজ হারানো এবং ব্যবসা-বণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া বাল্যবিয়ের যেহেতু একটি ট্রেডিশন আছে তাই করোনাকে বিয়ে দেয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন অনেকে।’

তিনি জানান, ‘যারা এই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তারা সবাই স্কুলের ছাত্রী। আর বিয়েগুলো হয়েছে শুক্র-শনিবার বন্ধের দিন-রাতে। বিয়ে হয়ে যাওয়া এসব ছাত্রীরা সবাই শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে। আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি তাতে ড্রপআউটের তথ্য পাচ্ছি। আমরা সে কারণে আরেকটি জরিপ করবো।’ বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতমঃ জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ-এর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা।

বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিবাহ বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সি বিবাহিত মেয়েরা।
এক্ষেত্রে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানুর ভাষ্য, আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজ চাইলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারবে। বাল্যবিবাহের ফলে সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের প্রকট বৈষম্য থাকার কারণেও নারীরা তাদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি নাসিমা আক্তার জলি বলেন, বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দারিদ্র্য ও অশিক্ষার জন্য পরিবারগুলো বাল্যবিবাহ দেয়। তাই পরিবারের দারিদ্র্য দূর করে যেন বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারি ঐ উদ্যোগ নিতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের প্রতিও সচেতন হতে হবে। ওয়ার আহ্বান করেন তিনি। দেশজুড়ে বাল্য বিবাহের কিছু চিত্রঃ জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে মোট ছাত্রী ৪৭০ জন। তাদের মধ্যে ৬৭ জনেরই চলতি বছর বিয়ে হয়ে গেছে। যাদের বিয়ে হয়েছে তারা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের সর্বোচ্চ বয়স ১৭ বছর। আর তাদের বেশির ভাগের বয়সই ১৬ বছর। তারা সবাই নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তবে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিয়ের ঘটনাও ঘটেছে।

সাতক্ষীরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রধান সাকিবুর রহমানের ভাষ্য, ‘করোনার সময়ে প্রধানত খরচ মেটাতে না পেরেই বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট ডাটা কেনা তাদের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর অভিভাবকদের আয়ও কমে যায়।’ তিনি জানান, বিয়ে হওয়া এ ছাত্রীদের কেউই আর স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুল থেকেও বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তারা মনে করছেন, ওই মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বিয়ের গল্প করলে অন্য মেয়েরাও বিয়েতে উৎসাহিত হতে পারে। আর যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই কাবিন নেই। ফলে বয়স নিয়ে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি।

আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফ ছাত্রীদের বাল্যবিয়ের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এবার ৬৮ জনের এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু পরীক্ষা দেবে ৪৭ জন। ২১ জন দিচ্ছে না। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। দশম শ্রেণীর ১৪-১৫ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরও চার-পাঁচ জন আছে বিয়ে হয়েছে। তারা নিচের ক্লাসে পড়ে।’

বাগেরহাটে বাল্য বিবাহ বেড়েছে ভয়ানক হারেঃ সরকারি তথ্য অনুযায়ী করোনার সময়ে বাগেরহাটে ৩ হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছেন। বাগেরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, করোনা শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকপর্যায়ের ৫২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ১৭৮জন শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কচুয়া উপজেলায় সব থেকে বেশি বাল্য বিবাহ হয়েছে। এই উপজেলায় ৫১৬টি বাল্য বিবাহ হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার অবস্থান। এই উপজেলায় ৪৯৭টি বাল্য বিবাহ হয়েছে। চিতলমারীতে ৪০৭, ফকিরহাটে ৩৯১, মোল্লাহাটে ৩৪৪, মোরেলগঞ্জে ৩৫৫, রামপালে ২৩৭, মোংলায় ২১৮ এবং শরণখোলায় ২১৩টি বাল্য বিবাহ হয়েছে।

এর বাইরে জেলার ৩৪ টি স্নাতক, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিকপর্যায়ের অপ্রাপ্ত বয়স্ক বেশ শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে। ঝরে পড়া ও বিদ্যালয়ে না যাওয়া হতদরিদ্র পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ে হয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রে কি পরিমান বাল্য বিবাহ হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোন দপ্তরের কাছে। অন্যদিকে বাগেরহাট জেলা রেজিষ্টারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ৫ হাজার ৭৩৯টি বিবাহ হয়েছে। অন্যদিকে ২ হাজার ৭৯৯টি তালাক সংগঠিত হয়েছে এই সময়ে। নিকাহ রেজিষ্ট্রারদের মাধ্যমে সংগঠিত সকল বিবাহে সরকার নির্ধারিত বয়স মানা হয়েছে বলে দাবি বাগেরহাট জেলা রেজিষ্ট্রারের।

মাত্র দেড় বছরে বাগেরহাট জেলায় বিপুল সংখ্যক বাল্য বিবাহ হওয়ার বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন সচেতন মহল। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করা হয়। এ আইন ১৯৩০ সালের ১ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর হয়। এই আইন ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়।আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে পুরুষের বিয়ের বয়স নূন্যতম ২১ এবং নারীর নূন্যতম ১৮ বছর নির্ধারিত হয়। এই বয়সের নিচে কেউ বাল্যবিবাহ করলে এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনাকারী, বাল্যবিবাহের শিকার সংশ্লিষ্টদের মা-বাবা বা অভিভাবকদের জন্যও একই শাস্তির বিধান আছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris