মঙ্গলবার

৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইরান ‘সুপরিকল্পিত-নিখুঁত’ হামলা চালাবে ইসরায়েলে

Paris
Update : শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪

আরা ডেস্ক : ইসরায়েলে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁত হামলা চালানোর বিষয়ে মিত্র ও পশ্চিমা দেশগুলোকে বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে ইরান। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যেন সংঘাত ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতেই মূলত এই ইঙ্গিত। ইরান ও ওমানের মধ্যে এই ইঙ্গিতের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওমান তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে একটি মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাচ্ছে। আলোচনা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে অবস্থিত ইসরায়েলি কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলা চালাবে না। ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) আল-কুদস ফোর্সে দুই শীর্ষ জেনারেলসহ সব মিলিয়ে ১১ জন নিহত হয়। যদিও ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে এই হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবে ইরান ইসরায়েলকেই এ জন্য দায়ী করে আসছে। সেই হামলার পর থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান ও আইআরজিসি প্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকেরা একাধিকবার ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না বলেই মনে করছেন ইরানের মিত্র, আরব ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনীতিকেরা। তাঁরা মনে করেন, ইরান এমন এক প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে যা মূলত এর ‘ডিটারেন্স’ বা যেকোনো শক্তিকে ঠেকানোর সক্ষমতা প্রকাশ করবে এবং একই সঙ্গে এই অঞ্চলে আঞ্চলিক সংঘাতও সৃষ্টির বিষয়টিও বন্ধ রাখবে। এ লক্ষ্যে ইরান সংযমী আচরণও করছে।
ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ‘হুমকি’ ইরানেরইসরায়েলের পাশে দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ‘হুমকি’ ইরানের তেহরানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ইরান মূলত চূড়ান্ত হামলার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে। একটা সময় পর্যন্ত ইরান ইসরায়েলের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও হামলার বিষয়ে অন্ধকারে রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণে বাধ্য করে দেশটিকে ক্লান্ত করতে চেয়েছে। ইরানের এই কৌশল কাজে দিয়েছে। ইসরায়েল তার সব নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছে। নাগরিকদের ভ্রমণ সতর্কতা দিয়েছে। একই সঙ্গে, পশ্চিমা দেশগুলোও দেশটিতে তাদের নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্ক করেছে।
ইরান প্রতিশোধ নিতে চাইলেও বন্ধুত্বপূর্ণ কোনো দেশে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসে হামলা চালাবে না। এ বিষয়ে পশ্চিমা এক কূটনৈতিক বলেন, ‘তেহরান তার কোনো বন্ধু দেশেই ইসরায়েলি কূটনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেবে না।’
পশ্চিমা ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ফলে ইরান যদি ইসরায়েলে হামলা চালায়ও তবে তা হবে খুবই সুপরিকল্পিত ও নিখুঁত। এই হামলা ইরানের তরফ থেকে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়াই নিশ্চিত করবে এবং একই সঙ্গে লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের যে উপস্থিতি সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ইরান যদি এই বিষয়ে ভুল করলে প্রতিক্রিয়া হবে খুবই ভয়াবহ।
এদিকে, ইসরায়েলও যেকোনো ফ্রন্টে ইরানি সমন্বিত হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত। বিশেষ করে, ইরানের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে দূরপাল্লার ড্রোন এমনকি লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর তরফ থেকেও এ ধরনের হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত তেল আবিব। এ ছাড়া, আরও দূরের কোনো স্থান থেকে আসা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও ঠেকাতে প্রস্তুত ইসরায়েল। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইরানের সঙ্গে শত্রুতা থাকলেও দেশ দুটি একবার ছাড়া আর কখনোই সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি। ২০১৮ সালে সিরিয়ায় মোতায়েন করা ইরানি সেনাদের সঙ্গে ইসরায়েলের একবার সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছিল। লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি থাকলেও দেশটি কখনোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সেনা মোতায়েন করেনি।
বিশ্লেষকদের মত, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে তেল আবিবের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে ইরানকে উসকানি দিচ্ছেন। তবে ইরানি শাসকশ্রেণি কোনোভাবেই এ ফাঁদে পা না দিতে মনস্থির করেছে। তবে এবার বিষয়টি না-ও ঘটতে পারে। ইরান দীর্ঘদিন সহ্য করলেও এবার প্রতিক্রিয়া দেখাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বলছেন, ইসরায়েল হয়তো এমন আক্রমণ সহ্য করবে, যা কেবল তাদের সামরিক অবকাঠামোই ধ্বংস করবে। কিন্তু বেসামরিক বা সামরিক কর্মকর্তা যদি ইরানি হামলায় নিহত হয়, তবে ইসরায়েল আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এমনকি দেশটি সরাসরি ইরানেও হামলা চালাতে পারে।
এদিকে, ইসরায়েলকে রক্ষায় ইরান ও তার প্রক্সিদের ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি তেল আবিব উত্তর ইসরায়েল সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক স্থাপনাগুলোকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সেখান থেকে বেশির ভাগ বেসামরিক জনগণকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নিয়োজিত মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড বা সেন্টকমের শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল মাইকেল কুরিলাকে ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে সম্ভাব্য সামরিক প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে। তিনি ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ও সমরবিদদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলেছেন, ‘ইরানি হামলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে রক্ষায় পূর্ণ মার্কিন সমর্থন আছে পেন্টাগনের।’
ইসরায়েল এরই মধ্যেই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করেছে। সেখানে লোকবল ও অস্ত্র-গোলাবারুদ বাড়িয়েছে। যার মধ্যে আছে স্বল্পপাল্লার রকেট ও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকে দেওয়ার আয়রন ডোম ও ডেভিডস স্লিং এবং অ্যারোর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ ছাড়া, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর সব সদস্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে ইসরায়েলের আশপাশে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের একটি দেশের কর্মকর্তা বলেছিলেন, ইরান প্রথমবারের মতো একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা মোতায়েন করতে পারে, যা তা সর্বোচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রদর্শন করবে ও দেশটি যে ইসরায়েলকে শাস্তি দিতে সক্ষমতা নিশ্চিত করবে। সর্বশেষ, ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা শুক্রবার ইরানের মানবহীন একটি আক্রমণকারী আকাশযানের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এটি তেহরান থেকে তেল আবিব পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে হামলা করতে সক্ষম। সব মিলিয়ে, ইরানের জন্য ইসরায়েলে হামলার বিষয়টি সক্ষমতা প্রদর্শন, ডিটারেন্স বজায় রাখা এবং দেশটির শাসকশ্রেণি বারবার যে ওয়াদা করেছেন, তা প্রমাণ করার। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা এবং বিভিন্ন দেশে থাকা প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে আস্থা দেওয়ারও তাড়না আছে দেশটির। আর তাই ইরানের কাছে ইসরায়েলে ‘সুপরিকল্পিত ও নিখুঁত’ হামলার সত্যিকার অর্থেই আর কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। সূত্র : আজকের পত্রিকা


আরোও অন্যান্য খবর
Paris