মঙ্গলবার

১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

অদক্ষতা-দুর্নীতির কারণে কমছে না সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসান

Paris
Update : বুধবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ। বরং প্রতি বছরই তা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এক ডজনের বেশি চিনিকল এভাবে বছরের পর বছর লোকসান গুণে আসছে। তবে সরকারি চিনিকলগুলো সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি চিনিকলের লোকসানের অন্যতম কারণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যয় বেশি। পাশাপাশি ব্যাংকঋণ থাকায় প্রতি বছরই চিনিকলগুলোকে পরিশোধ করতে হচ্ছে সুদ। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলগুলোর লোকসান হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৯-২০ হিসাব বছরে শ্যামপুর সুগার মিলের চিনি বিক্রির পরিমাণ ২০৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বিপরীতে ওই হিসাব বছরটিতে প্রতিষ্ঠানের কর-পরবর্তী লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬০৬ কোটি ৯২ লাখ ১০ হাজার টাকা। তার আগে ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ১৩১ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিক্রির বিপরীতে লোকসান হয় ৯৩১ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে লোকসান হয় ৪৬৯ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ওই বছর বিক্রি হয় ১৪৩ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ২৩৪ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিক্রির বিপরীতে লোকসান হয় ৩৪৮ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

একইভাবে জিল বাংলা সুগার মিল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে বিক্রি করে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৫৬ কোটি ২১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। আগের হিসাব বছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করে ৬২ কোটি ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ওই সময়ে মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তার আগে ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে লোকসান হয় ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩ হাজার টাকা। আলোচ্য সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ১৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। বছরটিতে লোকসান হয় ২৬ কোটি ৬১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে লোকসান হয় ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ওই বছর বিক্রির পরিমাণ ছিল ২২ কোটি ৬৪ লাখ ৯ হাজার টাকা।

সূত্র জানায়, পঞ্চগড় চিনিকল, ঠাকুরগাঁও চিনিকল, সেতাবগঞ্জ চিনিকল, রংপুর চিনিকল, রাজশাহী চিনিকল, নর্থবেঙ্গল চিনিকল, নাটোর চিনিকল, পাবনা চিনিকল, জয়পুরহাট চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, মোবারকগঞ্জ চিনিকল এবং ফরিদপুর চিনিকল বছরের পর বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে। তার মধ্যে পঞ্চগড় চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৪৭২ কোটি ৩৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা লোকসান করে। তাছাড়া ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৬২০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫৪৫ কোটি ৮১ লাখ ৯০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৩৩৭ কোটি ৯৬ লাখ ১০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩০২ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার টাকা লোকসান করে।

ঠাকুরগাঁও চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৬৮৩ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৭৯৭ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৭১৬ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৪২৩ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৪১৭ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে। সেতাবগঞ্জ চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে লোকসান করে ৪৮০ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তাছাড়া ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৬২৬ কোটি ৭ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫৬১ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৪৫৯ কোটি ৮৬ লাখ এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৪৪ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা লোকসান করে।

রংপুর চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৫২৯ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা লোকসান করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৬০৮ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫১৩ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৩৮৬ কোটি ৭৮ লাখ ৯০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ২৬০ কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে। রাজশাহী চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে লোকসান করে ৮৯১ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৮৩৯ কোটি ৫১ লাখ ৪০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৭৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ১০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৬২০ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার ও ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৪১৭ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা লোকসান করে। আর ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৮৬১ কোটি ৭৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে নর্থবেঙ্গল চিনিকল।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৭১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৬৮৬ কোটি ৩০ লাখ ৯০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৪৭৪ কোটি ৯৪ হাজার টাকা লোকসান করে। নাটোর চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে লোকসান করে ৮০৮ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। তাছাড়াও ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৮৪১ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৬৯১ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৫৫৫ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৪০৬ কোটি ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা লোকসান করে। পাবনা চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৭৫৪ কোটি ৭৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসান করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৬০৪ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা,

২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৬০৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৫২৭ কোটি ২৪ লাখ ৩০ হাজার ও ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৭৭ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে। জয়পুরহাট চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৬০১ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসান করে। তাছাড়াও ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৭৬৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫৭০ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৪০৩ কোটি ৯৬ লাখ ৭০ হাজার ও ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৪৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা লোকসান করে। কুষ্টিয়া চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৬১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা লোকসান করে।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৬১৭ কোটি ৮১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫৬৬ কোটি ২ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৫২২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৮২ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে। মোবারকগঞ্জ চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে লোকসান করে ৮৬৪ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তাছাড়া ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৯২৫ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৬৪৫ কোটি ৩ লাখ ৯০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৩৫৯ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৬১ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা লোকসান করে।

ফরিদপুর চিনিকল ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৬৩৮ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা লোকসান করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৭০৩ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৫৭৭ কোটি ৯২ লাখ ৭০ হাজার, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ৫৮৩ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার এবং ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ৩৮২ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা লোকসান করে। এদিকে সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসান প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের অভিমত, সরকারি চিনিকলগুলোর এতো বিপুল পরিমাণ লোকসান অস্বাভাবিক। সরকারি সবগুলো চিনিকলই পুরোনো কারখানা।

তাছাড়া আখের কোয়ালিটি খারাপ হওয়ায় চিনি উৎপাদনও কম হয়। আবার সময়মতো উৎপাদিত চিনি মিলগুলো বিক্রি করতে পারে না। পাশাপাশি নানা রকম দুর্নীতি, অদক্ষতা মিলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানি চিনিকলগুলোকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মাধ্যমে বিকল্প শিল্পায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বেজা বা বেপজার যৌথ উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগ বা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হতে পারে। যদি কেউ চিনি কারখানা করতে চায় তাও করা যেতে পারে।

কিন্তু শুধু চিনি কারখানার ওপর নির্ভরশীল না থেকে (চিনিকল যে এলাকায় অবস্থিত সেখানে) অ্যাগ্রো প্রসেসিং, ফুড প্রসেসিং এলাকার ওপর ভিত্তি করে ওই ধরনের কার্যক্রমের দিকে যাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বিক্রির কয়েকগুণ বেশি লোকসান হওয়ার বিষয়ে শ্যামপুর সুগার মিলের কোম্পানি সচিব শাফিনাজ উম্মে রুমানা জানান, প্রতিষ্ঠানটির অপারেটিং এক্সপেন্স (কোম্পানির পরিচালন ব্যয়) অনেক বেশি। এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে অনেক কমে তা বিক্রি করা হয়।

তাছাড়া কোম্পানির ব্যাংক লোন রয়েছে। সেজন্য প্রতি বছর সুদ যোগ হচ্ছে। তাছাড়া সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত আছে। সবকিছু মিলিয়েই লোকসান হচ্ছে। একই প্রসঙ্গে জিল বাংলা সুগার মিলের কোম্পানি সচিব আব্দুল গফুর মিয়া জানান, উৎপাদন খরচ আছে। সরকারি লোন আছে, ব্যাংকের লোন আছে অনেক। ওসব কিছু মিলিয়েই চিনিকলের লোকসান হয়েছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris