শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বাসহীনতা-বিভ্রান্তি!

Paris
Update : মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : করোনা মহামারীকালেও বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি খুব একটা পতন হয়নি, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিডিপিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বলতে গেলে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। এশিয়া, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের থেকেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। এটিও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ যেমন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচটি দেশের একটি, তেমনি সর্বোচ্চ আয়বৈষম্যের দেশগুলোরও একটি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। কেননা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিরাজ করছে বিভ্রান্তি।

মূলত বিভিন্ন সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন হিসেব দেয়ায় এ বিভ্রান্তির উৎপত্তি। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে আইএমএফ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিয়েছিল। এডিবি’র বিশ্লেষণে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক তাদের জরিপে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।

তবে যেকোনো সংস্থার অনুমানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সরকারি এ সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যা বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ও আগের অর্থবছরের চেয়েও অনেক বেশি। এর আগে গত নভেম্বরে প্রকাশিত সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সাধারণত কোনো অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের তথ্য এবং পরবর্তী ৩ মাসের অনুমানের ভিত্তিতে সাময়িক হিসাব করা হয়।

চূড়ান্ত হিসাবে সাময়িক হিসাবের সঙ্গে কিছুটা ব্যবধান থাকে। কিন্তু এত ব্যবধান সাধারণত থাকে না। অন্যদিকে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে করোনা সংক্রমণ বেড়েছিল। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছিল। সাধারণত বিবিএসের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, প্রায়ই তাদের তথ্য অচল কিংবা অসম্পূর্ণ থাকে। এর থেকেও মারাত্মক অভিযোগ হলো তাদের তথ্য প্রায়ই বানোয়াট থাকে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

বিশেষজ্ঞরাও জিডিপির এই উল্লম্ফন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। অনেকেই এটিকে অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে উল্লেখ করছেন। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্য, ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমার কাছে অস্বাভাবিক-বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। কীভাবে সম্ভব এত প্রবৃদ্ধি। এ প্রবৃদ্ধি মানুষের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। ভারতে গত অর্থবছরে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিক; সেটা ৩, ৪ বা ৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আমার কাছে সত্যিই অস্বাভাবিক লাগছে।

তবে এর বিপরীতে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখানে মিরাকলের ব্যাপার নেই। সংখ্যাটা বেড়েছে এই কারণে যে, আমাদের এক্সপোর্ট কিন্তু অনেক বেড়েছে আগের বছরের তুলনায়। এটার প্রভাব পড়েছে। আমাদের রেমিট্যান্স অনেক বেড়েছে, প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এ দুইটা কন্ট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে সরকারের ‘সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা’ এবং প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন হওয়ায় ‘সুফল’ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের মেথড অনুযায়ী আমরা জিডিপির হিসাব করি। বস্তুনিষ্ঠভাবে এই হিসাব করা হয়েছে।

উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না বলেও জানা গেছে। শিল্প খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও বেসরকারি বিনিয়োগের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কষ্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পেছনের সারির একটি দেশ। অথচ ক্রমবর্ধমান মূলধন উৎপাদন অনুপাত (ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) কমছে বলে সরকার বলছে। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, গত পাঁচ বছরে গড়ে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমে গেছে।

যেমন, ২০০৫-১০ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ আর ২০১০-১৬ সময়ে তা কমে হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির লাভ কার পকেটে গেল? নাকি হিসাবে গন্ডগোল আছে?
জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি নিয়ে এটিই প্রথম বিতর্ক নয়। বিতর্ক এর আগেও হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, অথচ কৃষি খাতে ছিল ঋণাত্মক, প্রবাসী আয়ও কমে গিয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অথচ ওই অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই সামান্য, ১ শতাংশের কিছু বেশি।

ওখানেই থেমে থাকে না বিতর্ক। প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় পরের অর্থবছরেও। সরকারের প্রাথমিক প্রাক্কলন ছিল, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কিন্তু হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এই হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য ছিল, উৎপাদন সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খুব বেশি না বাড়লেও কেবল ভোগ ব্যয়ের ওপর ভর করে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হবে না।

অনেকে অভিযোগ তুলছেন যে বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁদের মতে, দেশে ২০২০ এর মার্চ মাস থেকে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরপর থেকে দেশ দীর্ঘদিন লকডাউন অবস্থায় ছিল। সুতরাং অর্থনীতিতে এর প্রভাবটা শেষ প্রান্তিকে এসে বেশি বোঝা যায়। এ ছাড়া প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটা মোহ সৃষ্টি হয়েছে দেশে। এর কারণ হল- প্রবৃদ্ধি রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শুধু একটা সংখ্যা নয়, এর পেছনে অনেক তাৎপর্য রয়েছে।

যেমন মানুষের ওপর প্রভাব, নীতিমালার ক্ষেত্রে প্রভাব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এটা একটা রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই ভোগ করতে পারছে না, বা ভোগ করতে দেখা যাচ্ছে না। উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, কমেনি দারিদ্র্য ও বৈষম্য। ফলে এই প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তমূলক হয় না। সুতরাং এই সংখ্যা দিয়ে সাফল্য দেখাতে চাইলে, তা সঠিক নয় বলে মনে করেন তাঁরা।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে জিডিপি নিয়ে জনমনে এখন বেশ ভালোই সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এই সন্দেহ সরকারকেই দূর করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা, অর্থনীতির প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত না হলে, তথ্য প্রকাশ না পেলে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যেমন সঠিকভাবে গৃহীত হবে না, ঠিক একইভাবে দেশ উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যেও পৌঁছতে পারবে না।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris