শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংক ভোক্তাঋণে উদার হলেও প্রত্যাশিত গ্রাহক খুঁজে পাচ্ছে না

Paris
Update : মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই, ২০২১

এফএনএস : বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া শর্ত ও মহামারীসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগে ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে উদার হয়েছে। ওই ঋণের সুদহারও ইতিহাসের সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো প্রত্যাশিত গ্রাহক খুঁজে পাচ্ছে না। মূলত ক্রেডিট কার্ড, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার ঋণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঋণকে ভোক্তাঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দেশের প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সংগতি রেখে কয়েক বছর ধরেই দেশে ভোক্তাঋণের চাহিদা বাড়ছিল। আর ব্যাংকগুলোও ভোক্তাঋণের প্রবাহ বাড়াতে জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো গড়ে তুলছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস পুরো ভোক্তাঋণের কাঠামোকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভোক্তাঋণ উচ্চ সুদহারসহ নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। পণ্যে বৈচিত্র্যের অভাবের পাশাপাশি ওই ঋণের ব্যাপ্তিও ছিল ছোট। কিন্তু বিগত ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ভোক্তাঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ। কোনো কোনো ব্যাংক বর্তমানে ওই ঋণের সুদহার ৭-৮ শতাংশেও নামিয়ে এনেছে। কিন্তু তারপরও ভোক্তাঋণে প্রবৃদ্ধি আসছে না।

গত বছর ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ উচ্চ সুদহার সত্ত্বেও ২০১৭ সালে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশেরও বেশি। মূলত সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর ভর করেই ব্যাংকগুলোর ভোক্তাঋণের কাঠামো গড়ে উঠেছে। কিন্তু করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মহামারীতে আয় কমলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয় বেড়েছে।

করোনার প্রভাবে অনেকে চাকরিও হারিয়েছে। তাছাড়া বেতন কর্তনের মুখে পড়েছে বৃহৎ করপোরেটে চাকরি করা কর্মীও। এমন অবস্থায় ভোগ ব্যয় কমিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে মধ্যবিত্তরা। ব্যাংকারদের মতে, ঋণ নেয়ার সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই চেষ্টা করেও ভোক্তাঋণের বিতরণ বাড়ানো যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, মধ্যবিত্তরা ব্যাংক থেকে নেয়া ব্যক্তিগত ঋণে টিভি-ফ্রিজ, আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্য কিনে থাকে। কিন্তু মহামারীর ধাক্কায় দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে এসেছে। যে কারণে মধ্যবিত্তরা ভোগ ব্যয় কমিয়ে জীবননির্বাহের চেষ্টা করছে। ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব দেশের ভোক্তাবাজারের উৎপাদন ও বিপণনের ওপর পড়েছে।

আর চাহিদা পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন ভোক্তাঋণ বিতরণে বেশি সতর্ক। যদিও ভোক্তাঋণের উচ্চ সুদহার নিয়ে গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল। অনেক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের সুদহার ছিল ৩০ শতাংশেরও বেশি। তবে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব ব্যাংক ভোক্তাঋণের সুদহারও ৯ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে আসায় কোনো কোনো ব্যাংক বর্তমানে মাত্র ৭-৮ শতাংশ সুদে ভোক্তাঋণ বিতরণ করছে। যদিও ওই ব্যাংকগুলোই ২০১৯ সালের আগে ১৫-২০ শতাংশ সুদে ভোক্তাঋণ বিতরণ করেছিল। সুদহার কমলে ভোক্তাঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় বাজারে এর বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। বিগত ২০১৭ সালে ব্যাংক খাতে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে ভোক্তাঋণের ওই প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আবারো সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ভোক্তাঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ভোক্তাঋণের বড় অংশই ব্যক্তিগত ঋণ। সাধারণত চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার পরিমাণ বিচার করে ব্যাংকগুলো ব্যক্তিগত ঋণ দেয়। ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যবসার পরিধি বিচারে ব্যক্তিগত ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

ভোক্তা খাতের প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার গৃহ নির্মাণ ঋণ আছে। তাছাড়া ব্যাংকগুলোর বিপরণকৃত ক্রেডিট কার্ডে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণস্থিতি আছে। আর গাড়ি কেনার জন্য গ্রাহকদের মাঝে বিতরণকৃত ঋণ রয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। বিগত ২০১৫ সাল-পরবর্তী সময়ে দেশে ভোক্তা খাতের ঋণে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়। ২০১৬ সালে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।

তারপর ২০১৭ সালে ভোক্তা খাতের ওই ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালেও ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও তা ১২ শতাংশেরও বেশি ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে ভোক্তাঋণের ওই প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।

বর্তমানে কস্ট অব ফান্ড বা তহবিল ব্যয় কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের সামনের সারির কিছু ব্যাংক সুদহার কমিয়ে দিয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহক টানছে। যেসব ব্যাংকের তহবিল ব্যয় ৩ শতাংশের নিচে, তারা ৭-৮ শতাংশ সুদেও ভোক্তাঋণ দেয়ার প্রস্তাব করছে। সেক্ষেত্রে যে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় এখনো ৫ শতাংশের বেশি, সেসব ব্যাংক গ্রাহক ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, ক্রেডিট কার্ডসহ ভোক্তাঋণের মূল গ্রাহক সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। চলমান মহামারী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপনে খুব বেশি প্রভাব না ফেললেও মধ্যবিত্ত অংশ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের অনেক ভালো কোম্পানিও এ সময়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমিয়েছে।

অনেকে চাকরিচ্যুতির শিকার হয়েছে। সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয় বাড়লেও আয় কমে গেছে। ফলে ভোক্তাঋণের চাহিদাও অনেক কমে এসেছে। আবার ব্যাংকগুলোও এ খাতে ঋণ বিতরণে অনেক বেশি সতর্ক। ব্যাংক ও ভোক্তা উভয়ের রক্ষণশীলতার নেতিবাচক প্রভাবে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়েছে।

অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন জানান, মহামারীর ভীতিকর পরিস্থিতির কারণেই ২০২০ সালে ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণ বিতরণে দেখেশুনে হেঁটেছে। কারণ করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে।

গত বছর সাধারণ মানুষের মতো ব্যাংকারদের মধ্যেও আতঙ্ক ছিল। পাশাপাশি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপনেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। একদিকে চাহিদা পড়ে যাওয়া, অন্যদিকে ব্যাংকারদের বাড়তি সতর্কতার কারণে ভোক্তাঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তবে ২০২০ সালে কমলেও চলতি বছর ভোক্তাঋণ বিতরণে বাড়তি জোর দেয়া হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথমার্ধেই ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণ বিতরণ করেছে ৪২১ কোটি টাকা। জুন শেষে সিটি ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ শতাংশই রিটেইলে ছিল। চলতি বছরের বাকি সময়েও ভোক্তাঋণ বিতরণ ও আদায়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris