শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নানা উদ্যোগেও বন্ধ হচ্ছে না মানবপাচার

Paris
Update : রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

এফএনএস : সরকারের নানা উদ্যোগেও কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচার। বরং দিন দিন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বেশি বেতনের চাকরি ও উন্নত জীবনযাপনের প্রলোভনের টোপে ফেলে দালাল চক্র যুবকদের পাচার করছে। বর্তমানে দেশে পৌনে দুই লাখ মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। তার মধ্যে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৩০ হাজার ৭১১টি মামলা। আর গত ৮ বছরে মানব পাচার মামলায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এই সময়ে মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির হার খুব কম হওয়া পাচারকারীরা আরো বেপরোয়া। মানবপাচারের শিকারে পরিণত হওয়া অনেকেই বিভিন্ন দেশের বনেজঙ্গলে থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। আর প্রতিবছর দেশ থেকে ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পরও মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিক। অতিসম্প্রতি ভূমধ্যসাগর থেকে লিবিয়ার কোস্টগার্ড ১৬৪ জন এবং ইউরোপের দেশ উত্তর মেসিডোনিয়াতে যাওয়ার সময়ে ২০ বাংলাদেশীকে আটক করেছে মেসিডোনিয়ার পুলিশ। বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সরকার ওসব মানব পাচারের ঘটনা অবহিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওসব ঘটনার খবর পাওয়ার পর মানব পাচারকারী চক্র ও দালাল চক্রের খোঁজে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানায়, মানবপাচারের অভিযোগ দেশে নতুন কোন ঘটনা নয়। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় মানবপাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে লিবিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানে নিয়ে পাচারকারী শিকার হওয়া ব্যক্তিরা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়েও অনেকের সলিল সমাধি ঘটছে।

বিগত ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জনে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যে বিগত ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। আর গত আট বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মানব পাচার হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা।

সূত্র আরো জানায়, সিআইডির মানবপাচার মামলার নথির তথ্যানুযায়ী এক মামলায় ১১৮ বার তারিখ পড়ার পরও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির করার জন্য ৫৫ বার তারিখ পড়েছিল। তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় তারিখ পড়েছিল ৪৭ বার। এমন ধরনের ১৮টি মামলায় বারবার তারিখ পড়ার তথ্য জানা যায়। বিগত ২০১১ সালে দেশে ফিরে এসে একজন ভুক্তভোগী মামলা করে। ওই মামলা এখনো চলছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে আছে।

অথচ মানব পাচার আইনের মামলা জামিনযোগ্য নয়। তাছাড়া অনেক সময় দু’পক্ষ আপোস করে ফেলার কারণেও অনেক মামলা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ তদদন্ত প্রতিবেদন দেবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। কিন্তু দেশে তেমন নজির প্রায় নেই বললেও চলে। মানব পাচার আইন সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাবাস এবং মোটা অর্থদণ্ডের বিধান আছে।

কিন্তু বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত জাল বিছিয়ে রেখেছে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের থেকে দফায় দফায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়। এমনকি পাচারকারীদের খপ্পরে অনেককেই দেশ থেকে হুন্ডি করে টাকা নিতে হয়। অনেক সময় অভিবাসনের নামেও পাচার চলছে। ইউরোপে অভিবাসনের হাতছানিতে গত বছরও ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে এবং উদ্ধার হয়েছে অনেক বাংলাদেশী।

লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ২০১১ সালে ৩৭ হাজার বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছিল। তারপর থেকেই ওই দেশটি পাচারের পথ হয়ে ওঠে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা দালাল চক্র ওই পথে মানব পাচারের ব্যবসায় যুক্ত।

এদিকে মানবপাচার মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মতে, ৪টি কারণ মানব পাচার মামলার বিচারের ধীরগতি হওয়ার পেছনে কাজ করে। তার মধ্যে প্রধানতম কারণ হচ্ছে অভিযোগকারীর চেয়ে আসামিপক্ষ অর্থ-বিত্তে ক্ষমতাশালী হওয়া ও আসামিপক্ষ বেশি তৎপর থাকায় মামলার ওপর প্রভাব ফেলে। বাদীপক্ষ আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। মূলত অপরাধটির ভয়াবহতা নিয়ে বেশি প্রচার না থাকার কারণে সেটি সম্ভব হয়।

কারণ কোন অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শান্তির নজির না থাকলে কোন পক্ষই সেটি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয় না। এমন পরিস্থিতিতে মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় খুবই জরুরি। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও যশোরের অধিবাসী। মানবপাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে অবস্থান করে। তাদের হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরাও যথাযথ তথ্য দেয় না। তাছাড়া মানবপাচার মামলায় সাক্ষীও নিয়মিত পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে মানব পাচার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে একটি চমৎকার আইন হয়েছে। তাতে তদন্ত ও শাস্তিসহ বেশকিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু ওই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া জাতীয় যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে সেটাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বিগত ৮ বছরেও মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি। এ বছর ৭টি বিভাগে ট্রাইব্যুনাল চালু করে বিচার করার কথা আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনের যে আইনটি আছে তার বাস্তবায়ন করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন করা গেলে মানবপাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris