শনিবার

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সাত সদস্য গ্রেপ্তার

Paris
Update : বুধবার, ২৩ জুন, ২০২১

এফএনএস : আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের অন্যতম হোতা নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূর জাহানসহ (২৮) মানবপাচার চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল থানা পুলিশ। পুলিশ বলছে, পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে যশোর সীমান্তে বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত চক্রটি। পাচারকৃত প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এক হাজার টাকা করে নিত।

পাচারকালে কোনো মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য তাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসত। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর শ্যামলীর তেজগাঁও ডিসি কার্যালয়ে এসব কথা বলেন তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, যশোর ও নড়াইলে অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নদী ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া অন্যরা হলেন- মো. আল আমিন হোসেন (২৮), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মন্ডল (২৬), মো. তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে নদীর বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে রাজীব বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এরপর থেকেই নদী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

পাচারকৃত ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নদীর দশটির মতো নাম পাওয়া যায়। নদী ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। তেজগাঁওয়ের ডিসি বলেন, পাচার হওয়া নারীদের কাছে সে নদী হিসেবে পরিচয় দিলেও ভারতে তাকে সবাই ইতি নামে চেনে। ভারতীয় আঁধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। বাংলাদেশি পাসপোর্টে তার নাম নূরজাহান। সাতক্ষীরা সীমান্তে তার নাম জলি, যশোর সীমান্তে সে প্রীতি নামে পরিচিত।

গ্রেপ্তার আল আমিন হোসেন ২০২০ সালে ঈদ উল আযহার চারদিন পর নারী পাচার করতে গিয়ে বিএসএফ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়। পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে তার বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত। সে নারী পাচারের পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তার নামে যশোরের শার্শা থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার সাইফুল ইসলামের শার্শার পাঁচভূলট বাজারে মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা আছে।

মানবপাচারে জড়িত ইসরাফিল হোসেন খোকন, আবদুল হাই, সবুজ, আল আমিন ও একজন ইউপি সদস্য তার মাধ্যমে মানবপাচার থেকে অর্জিত অর্থ বিকাশে লেনদেন করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে সে মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের সতর্ক করে। বিকাশ ট্রানজেকশনে ব্যবহৃত মোবাইলটি জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার পলক মন্ডল যশোরের মনিরামপুর ঢাকুরিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গাহঘাটা থানার নলকড়া গ্রামে নানা বাড়িতে যায়।

সেখানে আবার পঞ্চগ্রাম স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাশ করে। পরবর্তীতে ইওঅগঝ (ইধপযবষড়ৎ ড়ভ অুঁৎাবফরপ গবফরপরহব ধহফ ঝঁৎমবৎু) ডিগ্রি নিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুরু করে। বেনাপোলের ইসরাফিল হোসেন খোকন, ভারতে অবস্থানকারী বকুল ওরফে খোকন, তাসলিমা ওরফে বিউটি ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিতে আসা গ্রাম্য দরিদ্র মেয়েদেরকে ব্যাঙ্গালোরে তাসলিমা ওরফে বিউটির কাছে পাঠানোর মাধ্যমে নারী পাচারের হাতেখড়ি।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত মেয়েদেরকে আঁধার কার্ড প্রস্তুত করে দেয়ার পাশাপাশি ‘সেফ হোম’ এ অবস্থান এবং ব্যাঙ্গালোরে নির্ধারিত স্থানে পাঠানোর দায়িত্ব নেয় সে। এছাড়াও সে ভারতীয় আঁধার কার্ড ও ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডধারী। সে উত্তর প্রদেশের গোরাক্ষপুর জেলার বড়ালগঞ্জ থানার নেওয়াদা গ্রামেও থেকেছে। তার কাছ থেকে তার ভারতীয় আঁধার কার্ড ভারতে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ড, ভারতীয় আয়কর বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ড, ভারতীয় সিম কার্ড ও একজন ভিকটিমের আঁধার কার্ড জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার বিনাশ সিকদার নড়াইলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সে বেনাপোলে বাসা ভাড়া নিয়ে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করে। তার স্ত্রী সোনালী সিকদার ভারতীয় নাগরিক। বেনাপোলে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতে গিয়ে ইসরাফিল হোসেন খোকন, আবদুল হাই সবুজ ও মানবপাচারে জড়িত আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে। যশোর ও নড়াইল থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরি বা প্রলোভন দেখিয়ে আনা নারীদেরকে ইসরাফিল হোসেন খোকন, আল আমিন, তরিকুল, আমিরুল ও আরো কয়েকজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে ভারতীয় দালালদের কাছে পৌঁছে দেয় সে।

তার কাছ থেকে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং দুটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে যেসব আঁধার কার্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে এসব ভারতীয়রা করেছেন নাকি বাংলাদেশি কেউ করে দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, এগুলো তৈরিতে ভারতীয় লোকেরা সহায়তা করেছে।’

নদীর সঙ্গে টিকটক হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নদী, হৃদয় বাবুসহ আরও দুয়েকজনের নাম আগে উল্লেখ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের সহযোগিতায় তারা পাচার করেছে। ভারতে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে ওই ভিডিওর সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততা কতটুকু? এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিসি বলেন, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেহেতু নদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু ওই ভিডিওর সঙ্গেও নদীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

সাতক্ষীরা ও যশোর এলাকায় মানবপাচারের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি পাচার কাজে জড়িত রয়েছে। তবে তদন্তের শেষ পর্যায়ে বলতে পারব কারা কারা পাচারে সহযোগিতা করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris