শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্যা ব্যবস্থাপনায় চীন-ভারত ও বাংলাদেশের সহযোগিতা জরুরি

Paris
Update : শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০২২

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা (জিবিএম) নদীর অববাহিকায় ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান। এই নদীগুলোর সঙ্গে ভুটান, চীন ও নেপালেরও যোগসূত্র রয়েছে। দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া পানিবণ্টনজনিত ব্যবস্থাপনা ও সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। বন্যা বা খরা যাই হোক না কেন, এসব বিষয়ে দেশগুলোর তথ্য শেয়ার করতে হবে। আশার খবর হলো, গত ১৪ জুন দিল্লিতে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের সপ্তম অধিবেশনে (জেসিসি) বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশই অভিন্ন নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। করোনা মহামারি শুরুর পর জেসিসি শুধু একটি ভার্চুয়াল সভা করেছিল। তবে এবার তারা সশরীরে সভার আয়োজন করে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ-ভারতের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বন্যার পানি ব্যবস্থাপনা ও পূর্বাভাস কর্মসূচি আরও প্রসারিত করতে একমত হয়েছেন। এতে দুই দেশের ক্ষয়ক্ষতি কমবে। ভারত-বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেগ তৈরি করেছে। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ। ওই রাজ্যগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ও তাদের আবহাওয়ার ধরনের প্রভাব বাংলাদেশের বাস্তুতন্ত্র ও ভূগর্ভে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে ৫৪টি নদীর সম্পর্ক রয়েছে। নদীগুলোর সঙ্গে দুদেশের জনসংখ্যার জীবনযাপনে সরাসরি প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। যার ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। উঁচু এলাকাগুলো থেকে বন্যার স্রোত নিচু অঞ্চলে, বিশেষ করে হাওড়, হ্রদ ও অন্য জলাভূমিগুলোতে পলির সঞ্চার করছে। এর ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর মাত্রা ও তীব্রতা বাড়তে পারে। -এফএনএস

 

বিশেষ করে, বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল ও উচ্চ জনবহুল এলাকায়। কাজেই বন্যার পানি ব্যবস্থাপনার জন্য দুদেশের কার্যকর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোর মূল্যায়ন করাও জরুরি। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে নিচু। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত পানি ছেড়ে দিলে বাংলাদেশে বন্যা ভয়াবহ মাত্রা লাভ করে। লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারত শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি দেয় না। ফলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, গত জুনে ভারত গজলডোবা ব্যারাজের ৫৪টি গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যায়। এতে উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলার ৬৩টি গ্রামের এক লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে। উল্লেখ্য, গজলডোবার সব গেট খুলে দেয়ায় তিস্তা ব্যারাজ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল এবং ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ ৪৪টি গেট খুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এতে বোঝা যায়, বন্যা ব্যবস্থাপনা ও পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা উচিত। ভারতের মনে রাখতে হবে, বন্যায় শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, বাংলাদেশের ভূখণ্ড সংলগ্ন ভারতীয়রাও একই সমস্যায় পড়েন। সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো চরম আবহাওয়ার সাক্ষী হয়েছে। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। কারণ, বাংলাদেশ অত্যন্ত জনবসতিপূর্ণ। গত ২৫ জুলাই বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বন্যায় দেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮টি জেলা। বন্যায় আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৮৬ হাজার ৮১১ কোটি ৬৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭২ টাকা। এ সময় শুধু পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এ ছাড়া সাপের কামড়, বজ্রপাতসহ মোট মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের।

 

আহত হয়েছেন ২ হাজার ৮৮০ জন; আশ্রিত মানুষের সংখ্যা ৭২ লাখ ৮১ হাজার ২০৪ জন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬ জন। মানবিক এই বিপর্যয়ে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ ও উন্নয়নমূলক সংস্থা। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা খাদ্যসহায়তা, সুপেয় পানি, নগদ টাকা, ওষুধ, শিক্ষা ও শিশু-নারীদের স্বাস্থ্যগত সেবা প্রদান করছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বন্যার্ত এলাকায় প্রায় তিন লাখ ডলার বরাদ্দ করেছে। এগিয়ে এসেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউএনএফপিএ। এ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১১ কোটি, যুক্তরাজ্য ৭ কোটি, যুক্তরাষ্ট্র ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। এ ছাড়া সুইডেন ১২ কোটিরও বেশি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় শুধু আর্থিক সাহায্য যথেষ্ট নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাবও ফেলবে না। প্রয়োজন আঞ্চলিক ও পারস্পরিক সহযোগিতা ও চুক্তি। ইতোমধ্যে ভারত বন্যা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমরা উত্তর-পূর্বে বন্যা দেখেছি। আমরা এখন দীর্ঘমেয়াদি বন্যা নিয়ন্ত্রণের তথ্য শেয়ার করছি।’ তিনি আরও বলেন, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ৫৪টি নদীর সংযোগ রয়েছে। এটি দুদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়ে সহযোগিতা প্রয়োজন। বন্যা প্রতিরোধের উত্তর খুঁজতে চীনকেও শামিল হতে হবে। কারণ, চীনের সঙ্গে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সংযুক্তি রয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে চীনকেও সহযোগিতা করতে হবে। চীন প্রাণঘাতী এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান-চীনকে নিয়ে একটি বন্যা ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা এখন সময়ের দাবি।

 

এদিকে পানি সম্পদের ব্যবহার এবং বন্যা ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন সংক্রান্ত নেপাল-বাংলাদেশ জয়েন্ট এক্সপার্ট কমিটির (জেইসি) ষষ্ঠ সভা কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার(২৮ জুলাই) এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। কাঠমান্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। আর নেপালের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির জ¦ালানি, পানিসম্পদ ও সেচ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব সাগর কুমার রাই। বৈঠকে এই অঞ্চলে পানিসম্পদের উন্নততর ব্যবস্থাপনায় যৌথ সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। উভয় পক্ষ বন্যা পূর্বাভাসের জন্য তথ্য বিনিময়ের পাশাপাশি অভিন্ন নদীগুলির অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় যৌথ প্রকল্প গ্রহণের ওপর গুরুত্ত্বারোপ করে। বাংলাদেশ ও নেপালের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, বন্যা ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে কার্যক্রম গ্রহণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় জয়েন্ট টেকনিক্যাল স্টাডি টিমের (জেটিএসটি) প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে। পরে জেইসির পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার গত বুধবার নেপালের জ¦ালানি, পানিসম্পদ ও সেচ মন্ত্রী পমফা ভুসালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া সফরকালে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপালের কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শন করবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris