নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁয় একদিনের বৃষ্টিতে আবাদি আলুর জমিতে ব্যাপক পানি জমেছে। এই জমে থাকা পানির কারণে আলুর ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, আর কিছু দিন পরেই আলু তোলার সময়, এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টির কারণে আলুর জমিতে পানি জমে গেছে। এ অবস্থায় যদি ৩ থেকে ৪ দিন থাকে, তা হলে আলু নষ্ট হতে পারে। সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের দরিয়াপুর গ্রামের আলুচাষি আশরাফুল জানান, হঠাৎ বৃষ্টিতে আলু জমিতে পানি জমেছে। জমিয়ে থাকা পানিগুলো সেচ দেওয়া হচ্ছে।
পুনরায় বৃষ্টি হলে আলু পানিতে তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। তবে রোববার অথবা সোমবার থেকে টানা রোদ দেখা দেয় তাহলে আলু কিছুটা রক্ষা পেতে পারে। একই গ্রামের কৃষক জাকির বলেন, আর কয়েক দিন পর আলু উত্তোলন করার পর ওই জমিতে আবার বোরো ধানের চারা রোপন করার কথা। হঠাৎ বৃষ্টিতে আলুর জমিতে পানি জমে গেছে। এভাবে আলু পানিতে ডুবে থাকায় বেকায়দায় পড়েছে তিনি।
নওগাঁ সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামের আলু চাষি লতিফুর রহমান বলেন, আমি সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেছি। চলতি মাসের শেষের দিকে ক্ষেত থেকে আলুগুলো উঠাবো। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। চেষ্টা করছি ক্ষেত থেকে বৃষ্টির পানি সরাতে কিন্তু বৃষ্টি তো একবারে থামছেইনা। যদি আরও ৩ থেকে ৪ দিন ধরে বৃষ্টি হয় তবে, ক্ষেতে পানি আরও জমে যাবে আলুর ক্ষেতে পচন ধরতে পারে। ফলন কমে যেতে পারে। এমন অবস্থায় খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পারইল গ্রামের আলু চাষি আব্দুস ছালাম বলেন, হঠাৎ মাঘের বৃষ্টিতে আলুর জমিতে পানি জমেছে। জমে থাকা পানিগুলো সেচ দেওয়া হচ্ছে। তবে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছেই। আমি ৩বিঘা জমিতে আলুর চাষ করেছি। আরও ৩ থেকে ৪ দিন যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আর ফলনও কম হবে। শুনলাম রবিবার পর্যন্ত নাকি থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। সব মিলে খুব চিন্তা হচ্ছে এখন। এমনটা হলে লোকশানে পড়তে হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ বলেন, এই বৃষ্টিতে ফসলের কোন ক্ষতি হবেনা।
ধান-গম ও ভুট্টার জন্য আর্শীবাদ হয়েছে এই বৃষ্টি। তবে যদি একটানা ৩ থেকে ৪দিন বৃষ্টি হয় তাহলে আলু ক্ষেতের ক্ষতি হতে পারে। ফলন বির্পযয় হতে পারে। কারন টানা বৃষ্টিতে ক্ষেতে ইতিমধ্যে আলুর ক্ষেতে পানি জমে গেছে। যার কারনে আলুর ক্ষেতে পচন ধরতে পারে। তাহলে আশানুরুপ ফলনের বিপর্যয় হতে পারে। চাষিরাও এতে করে লোকশানের মুখে পড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, এমন অবস্থায় আলুগুলো তুলেও কোনো লাভ হবে না। তুলে রেখে দিলেও সেগুলো পচে যেতে পারে। বৃষ্টি কমার পর অবস্থা অনুযায়ী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া নাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
মাঠ পর্যায়ে কৃষি অফিসাররা চাষিদের সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। নওগাঁর বদলগাছীর স্থানীয় কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা-ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে। রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে আগাম জাতের আলুর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৫০ হেক্টর।
মান্দা প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দায় মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহের বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। তলিয়ে গেছে নিচু এলাকার রোপণকৃত বোরো ধান। ক্ষতির মুখে পড়েছে আলু, পেঁয়াজ, সরিষাসহ রবিশস্যের খেত। আকস্মিক বৃষ্টিতে কাঁচা ইট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে ইটভাটা মালিকদের।
বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাগরে লঘুচাপের কারণে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২ টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শুক্রবার দিনভর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। জেলার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৪ মিলিমিটার। কৃষকের বলছেন, হঠাৎ বৃষ্টিতে নিচু এলাকার সদ্য রোপনকৃত বোরো ধানের চারা তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে অনেক বীজতলা। দু’একদিনের মধ্যে পানি সরে না গেলে রোপনকৃত জমির চারা পচে নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন করে ওইসব জমিতে আবারো চারা রোপন করতে হবে। এতে চারার সংকট দেখা দিবে। চারা না পেলে নষ্ট হওয়া জমিতে দ্বিতীয়বার ধান রোপন করা সম্ভব হবে না। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়বেন তাঁরা।
অন্যদিকে ইটভাটার মালিকেরা বলছেন, অসময়ের হঠাৎ বৃষ্টিতে ভাটার খলিয়ানে থাকা কাঁচা ইট গলে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়বেন ভাটা মালিকেরা। উপজেলার পশ্চিম নুরুল্লাবাদ গ্রামের কৃষক মনসুর রহমান বলেন, বৃষ্টিতে তাঁর ৪০ কেজির ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। পানি সরে না গেলে বীজতলার চারা নষ্ট হয়ে যাবে। এতে চারার সংকট দেখা সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে তাঁর রোপনকৃত দুই বিঘা জমির ধানও তুলিয়ে গেছে পানিতে। চলতি মৌসুমে তিনি ১৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছেন উপজেলার নলতৈড় গ্রামের কৃষক আবুল কালাম। তিনি বলেন, হঠাৎ বৃষ্টিতে তাঁর পেঁয়াজের জমিগুলোতে পানি আটকে গেছে। পানি সরে না গেছে পেঁয়াজের চারা পচে নষ্ট হবে। এতে চরম ক্ষতির মুখে পগবেন তিনি।
ভাটামালিক খলিলুর রহমান বলেন, মাঘ মাসের শুরুতে একদফা বৃষ্টিতে অন্তত ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এবারের বৃষ্টিতে রোদে শুকাতে দেওয়া কাঁচা ইটগুলো আবারো বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে। এ ছাড়া পোড়ানোর আগে শুকানো সারিবদ্ধ করে রাখা ইটগুলোও বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এবারও বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তিনি। গতকাল শনিবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রবিশস্যের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে কপি, আলু, পেঁয়াজ, সরিষাসহ নানা ধরণের সবজির খেতে পানি থইথই করছে। চড়া দামে সার ও বীজ কিনে তাঁরা চাষবাদ করেছেন।
কিন্তু শীতকালের হঠাৎ বৃষ্টি তাঁদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘যেহেতু বৃষ্টি থেমে গেছে। শনিবারে রোদের দেখা মিলেছে। সেহেতু রবিশস্যের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। কৃষকদের জমি থেকে পানি সরানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বোরো ধানের মাঠে যেখানে পানি জমেছে সেগুলোতে ছত্রাক দেখা দিতে পারে। তবে পানি সরানো গেলে সমস্যা হবে না। বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুর রহমান বলেন, সাগরে লঘুচাপের কারণে বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত একটানা ভারী বৃষ্টি হয়।
এছাড়া শুক্রবার সারাদিনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে শুক্রবার পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৪৪ মিলিমিটার। ধামইরহা থেকে প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর ধামইরহাটে গত দুই দিন ধরে মাঘ মাসে আকস্মিক অবিরাম বৃষ্টিতে ইটভাটার ক্ষতি হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া অসময়ে প্রবল বৃষ্টির কারণে রবি ফসল হিসেবে সরিষা ও আলুরও ক্ষতি হয়েছে। এতে হাজারো কৃষক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন। গত বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত থেমে থেমে ধামইরহাট উপজেলার উপর দিয়ে প্রবল ঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এতে এলাকার ১৬টি ইটভাটার লক্ষ লক্ষ কাঁচা ইট পানিতে মিশে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
এসব পানিতে নষ্ট হওয়া ইট আবারো নতুন করে কচিয়ে ইট তৈরি করতে হবে। এতে এক ইট তৈরি করতে এখন দ্বিগুন খরচ করতে হবে। উপজেলার হরিতকীডাঙ্গায় অবস্থিত বিএবি ইটভাটায় ১০ লক্ষ,বিহারীনগরে এমবিবি ইটভাটায় ৭ লক্ষ এবং বস্তাবর চৌঘাট এলাকায় অবস্থিত বিসমিল্লাহ ইটভাটার ১৫ লক্ষ ইট বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। উপজেলার ১৬টি ইটভাটায় লক্ষ লক্ষ ইট নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া হাজার হাজার কৃষক তাদের রবি শস্য আলু ও সরিষা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অবিরাম ভারী বৃষ্টির কারণে ক্ষেতের সরিষা মাটিতে ন্যূয়ে পড়েছে। অধিকাংশ সরিষা ও আলুর গাছগুলো বৃষ্টির পানিতে ক্ষেতের মধ্যে তলিয়ে যায়।
অনেক কৃষক বিভিন্নভাবে জমিয়ে থাকা পানি বের করার চেষ্টা করেন। সরিষার চেয়ে আলুর ক্ষতি বেশি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেতের আলু তোলার আগ মুর্হুতে এ বৃষ্টির কারণে অনেক আলুতে পচন ধরবে। এসব আলু সংরক্ষণ করা যাবে না। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে,চলতি মওসুমে এবার ২হাজার ৫শত ৭০ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল সরিষা এবং প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছেন কৃষকরা। রোগ বালাই না থাকায় এবার আলু ও সরিষার ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ধামইরহাট উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সেক্রেটারী মো.আখরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,আকস্মিক বৃষ্টিতে উপজেলার ১৬টি ইটভাটার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিটিভাটায় লক্ষ লক্ষ ইট বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। ১৬টি ভাটায় প্রায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার ইট নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো.তৌফিক আল জুবায়ের বলেন,এলাকার প্রায় ৬৫ ভাগ জমির আলু ইতোমধ্যে কৃষকগণ উত্তোলন করেছেন। যেসব আলু সংরক্ষণ করা হবে সেগুলো ক্ষেতে রয়েছে। তবে রোদ হলে ওসব আলুর তেমন ক্ষতি হবে না। এছাড়া সরিষার এবার বাম্পার ফলন হবে। তবে বৃষ্টির কারণে কয়েকদিন পর জমি থেকে কাটামাড়াই শুরু হবে। বৃষ্টির কারণে মাড়াই কয়েক পিছিয়ে যাবে তবে সরিষার ফলন ভালো হবে বলে তিনি আশাব্যক্ত করেন।