শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জয়পুরহাটে ৬ মাসে ৭৪ ট্রান্সফরমার চুরি, বিপাকে সেচ পাম্প মালিকরা

Paris
Update : সোমবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : জয়পুরহাটে কৃষি কাজের জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সেচপাম্পের ৭৪টি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরি হলেও একটিও উদ্ধার না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সেচপাম্প মালিকরা। জেলার ৫ উপজেলার কৃষকদের বিভিন্ন মাঠে এসব ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি হওয়া ট্রান্সফরমারগুলোর একটিও উদ্ধার না হওয়ায় কৃষকরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এদিকে ট্রান্সফরমার উদ্ধারে পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে পুলিশ প্রশাসন, জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন (বিএমডিএ) কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরেজমিন জানা গেছে, কৃষি জমিতে সেচ কাজের জন্য জেলার ৫ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের ১ হাজার ৮৭৫টি গভীর, ৩ হাজার ৪৯৩টি অগভীর ও ২টি এলএলপি নলকূপ রয়েছে। আর বিএমডিএর ৩৫৯টি গভীর নলকূপ রয়েছে। জেলায় এসব বিদ্যুৎ চালিত মোট ৫ হাজার ৩৭০টি নলকূপের জন্য প্রায় ৮ হাজার ট্রান্সফরমার রয়েছে। এসব ট্রান্সফরমাগুলোর মধ্যে গত ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে চুরি হয়েছে ৭৪টি, এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের ৫৩টি ও বিএমডিএর ২১টি।

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন (বিএমডিএ) কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ট্রান্সফরমারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেচপাম্প অপারেটরদের প্রতি ঘণ্টায় শতকরা ১০ টাকা কমিশন দেওয়া হলেও চুরি ঠেকানো যায়নি। প্রতিটি ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ার পর সেচ পাম্প মালিকদের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক থানায় অভিযোগ বা সাধারণ ডায়রি করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হলেও কোনো ট্রান্সফরমারই উদ্ধার বা কোনো অপরাধীই গ্রেফতার হয়নি। সেচ পাম্পগুলোর ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ার পর সেগুলো উদ্ধার না হওয়ায় পুনরায় সেচপাম্প মালিকদের কিনতে হয়েছে।

চুরি হওয়া ট্রান্সফরমার উদ্ধার না হওয়াসহ দোষীরা আইনের আওতায় না আসায় আবারো চুরি হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন সেচপাম্প মালিকরা। এ ছাড়া মূল্যবান তামার তারের জন্যই সেচপাম্পগুলো চুরি হচ্ছে বলেও জানান স্থানীয় পল্লী বিদ্যুত ও বিএমডিএ’র কর্তৃপক্ষসহ সেচ পাম্প মালিকরা। এছাড়া সদর উপজেলার তেঘর দন্ডপানি গ্রামের জাহিদুল ইসলামের ৩টি, ক্ষেতলাল উপজেলার বড় তারা গ্রামের মাহফুজার রহমানের ৩টি, মামুদপুর-দেওগ্রামের মিলন মন্ডলের ৩টি, আক্কেলপুর উপজেলার পূর্ণ্য গোপীনাথপুর গ্রামের শফিকুল ইসলামের ১টি, কালাই উপজেলার মোলামগাড়িহাট গ্রামের মজিবর রহমানের ৩টি, পাঁচবিবি উপজেলার ভূই ডোবা গ্রামের এনামুল হকের

৩টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার কয়তাহার গ্রামের সেচ পাম্প মালিক আবদুল মজিদ মল্লিক বলেন, গত ২৭ অক্টোবর আমার পাম্পের ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দিয়েও লাভ হয়নি। ফসল রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে কষ্ট করে টাকা যোগাড় করে ট্রান্সফরমার সংগ্রহ করে সেচ কাজ চালু রেখেছি। ট্রান্সফরমার চুরি বন্ধে পুলিশসহ প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একই উপজেলার আমদই-মীরগ্রাম এলাকার সেচ পাম্প মালিক হাফিজুর রহমান একই অভিযোগ করে জানান, আমার সেচপাম্পের ৩টি ট্রান্সফরমার চুরি হলে আলুসহ অন্যান্য ফসলি জমিতে সেচ সংকট দেখা দেয়। এতে কৃষকরা চরম বিপাকে পড়ে।

পরে আমি ধার করে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিতে ৯৩ হাজার টাকা জমা দিয়ে ট্রান্সফরমারগুলো সংযোগ করে কৃষকদের জমিতে পানি দিয়ে ফসল রক্ষা করেছি। ট্রান্সফরমার চুরির শিকার অনেক সেচপাম্প মালিক অভিযোগ করেন, ট্রান্সফরমারগুলোর ভেতরে ১২ থেকে ২০ কেজি পরিমাণ তামার তার রয়েছে। প্রতি কেজি তামার মূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই মূল্যবান তামার জন্যই মূলত ট্রান্সফরমার চুরি হয়। চুরি হওয়া ট্রান্সফরমারগুলো প্রতিস্থাপন করতে প্রথম বার চুরি হলে সরকারি মূল্যের শতকরা ৫০ ভাগ বা এক লক্ষ টাকা অর্থ জমা দিলে পুনরায় তাদের ট্রান্সফরমার দেওয়া হয়। তবে দ্বিতীয় বার চুরি হলে সেচপাম্প মালিকদের ট্রান্সফরমারের দুই লাখ টাকা বা ১০০ ভাগ অর্থ জমা দিয়ে ট্রান্সফরমার নিতে হয় বলেও জানান ভূক্তভোগী সেচপম্প মালিকরা।

সে হিসাবে সেচপাম্প মালিকদের পকেট থেকে গেছে প্রায় কোটি টাকা আর চোরদের পকেটে ঢুকেছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। তারা আরো বলেন, প্রতিটি ট্রান্সফরমার চুরি হলে থানায় সাধারণ ডায়রি বা অভিযোগ করার পর সেই সাধারণ ডায়রি বা অভিযোগপত্রের ১ কপিসহ নির্ধরিত অর্থ জমা দিয়ে অনেক দুর্ভোগ শেষে নতুন ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপন করা যায়। এর কোনো প্রতিকারই পাচ্ছে না না বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এদিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবস্থায় এত উপরে বৈদুতিক খুঁটি থেকে ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি যেমন সহজ নয়, আবার বৈদ্যুতিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ কোনো সাধারণ চোরের পক্ষে ট্রান্সফরমার চুরি করাও অসম্ভব বলে জানান সেচপাম্প মালিকসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মচারী এরসঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলেও তারা জানান। জয়পুরহাট পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়ার জেনারেল ম্যানেজার এনামূল হক প্রামানিক ও বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তাদের পক্ষে চোর ধরা সহজ কাজ নয়, তাই প্রতিটি সেচ পাম্প মালিক ও কৃষকদের সমন্বয়ে পাহারা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জয়পুরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম জানান, ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ার পর মামলা হলে তদন্তের জন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সাধারণ ডায়রি বা অভিযোগ দেওয়া হয় বলে এসব বিষয়ে স্বাভাবিক কারণে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris