মঙ্গলবার

২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারে বছরে বাঁচবে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল

Paris
Update : শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২১

এফএনএস : প্রতি বছর সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণে খাদ্য শস্য। তবে এবার কৃষকের উৎপাদিত ফসল পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে পরমাণু শক্তির রেডিয়েশন ব্যবহার করা হবে। বিশেষ এক প্রযুক্তির মাধ্যমে এ রেডিয়েশন ব্যবহার করবে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা। তারওপর প্রতিবছর কৃষকের অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল পচে নষ্ট হচ্ছে, শুধু সংরক্ষণের অভাবে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের ফলে হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমি।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, উপকরণ ব্যবহারে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, ভূমির স্বাস্থ্য ক্ষয়, সংগ্রহোত্তর ক্ষতি, সংরক্ষণাগারের অভাব, উৎপাদন উপকরণসমূহে প্রয়োজনীয় ভর্তুকির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে জনগণের খাদ্য চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এর ওপর উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে নষ্ট হলে দেশ খাদ্য চাহিদা মেটাতে পড়বে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে।

এই পরিস্থিতিতে কীভাবে কৃষকের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করা যায়, সে উপায় বের করতেই কাজ করছে বিনা। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে ফসল রক্ষার নতুন পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে সংস্থাটি। সেটি হলো আধুনিক বিকিরণ প্রযুক্তি। বিনার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বীকৃত ও কার্যকর এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসলের এত বিশাল ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। এ প্রযুক্তি বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ চলছে। ‘বঙ্গবন্ধু গামা ইরাডিয়েশন সেন্টার’ স্থাপন শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর নতুন পন্থা বাস্তবায়িত হবে মাঠ পর্যায়ে।

বিনা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্বের সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কম-বেশি দেখা যায়। প্রতিবছর ফসল সংগ্রহের পর ক্ষতির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্যের যোগানের সমস্যাগুলো যে কোনো দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য। কৃষিতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো, প্রতি বছর মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কৃষিপণ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি উপাত্ত (বিবিএস, ২০১৯) অনুসারে, দেশে কেবল পেঁয়াজ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, আলু ৫-৮, ধান ৮-৯, ডাল ৫-৬ এবং আমের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ, যা অর্থের বিবেচনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।

বিনা আরও বলছে, প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত ৪ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়, যার মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। পেঁয়াজ কৃষকের ঘরে তোলার পর স্বীকৃত ও স্বল্পমাত্রায় কার্যকর আধুনিক পরমাণু বিকিরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে এ ধরনের ক্ষতি ৯০-৯৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। একইভাবে দানাদার অন্যান্য শস্য, আদা, রসুন, কাচামরিচ, ফল ও শাক-সবজি ইত্যাদি ফসলের ক্ষেত্রেও পরমাণু প্রযুক্তিটি কার্যকর।

এটি একটি ভৌতিক প্রক্রিয়া, যেখানে বাল্ক বা প্যাকেটজাত কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিকিরণ (গামা রে, এক্স-রে কিংবা ইলেক্ট্রন বিম) প্রয়োগ করা হয়। প্রযুক্তিটি কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর পোকা ও কীটপতঙ্গ, পরজীবী, রোগজীবাণু এবং অণুজীব ধ্বংস হয় ও পণ্যের পচন রোধ হয়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। ফলে ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়। প্রক্রিয়াটি খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য, কোয়ারেন্টাইন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে বাধ্যতামূলকভাবে বহুল ব্যবহৃত।

সূত্র জানায়, ইরাডিয়েশন সেন্টারটি স্থাপন করা হলে এটির ক্ষমতা বিবেচনায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আম, কলা, পেয়ারা, ডাল শস্যে গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা মূল্যমানের কৃষিপণ্যের পচন রোধসহ পোকা ও কীটপতঙ্গ হতে এসব পণ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি যন্ত্রটির সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রায় ২৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের সুবিধাভোগী এলাকার কৃষকসহ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব অংশীজন তাদের পণ্যসমূহ নিজস্ব গুদামে তিন থেকে চার মাস মজুত রেখে প্রতিবছর মোট সংগ্রহোত্তর ক্ষতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমাতে সক্ষম হবে। এতে কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ খাদ্য-নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের সরবরাহ বাড়বে।

বিনার দাবি, ইরাডিয়েশন সেন্টার স্থাপন হলে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র যেমন বাড়বে, তেমনি অন্যান্য খাতের দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যসামগ্রী জীবাণুমুক্ত করার সুযোগ পাবে ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। পাশাপাশি বিকিরণ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি বিষয়ক মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাইলট প্ল্যান্টটির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও বন্দরসমূহে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গামা ইরাডিয়েটর স্থাপন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তিটি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব হবে এবং তা পণ্য রপ্তানিতেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, গামা রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমরা যে মাত্রায় এটা ব্যবহার করি, আমরা বীজে যে রেডিয়েশন ব্যবহার করি, তাতে ক্ষতির ঝুঁকি নেই। বীজ থেকে রেডিয়েশন বের হলে তা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। পরমাণু রেডিয়েশন ব্যবহারের ফলে ফসল নষ্টের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামবে। পেঁয়াজ উৎপাদনশীন এলাকায় এ প্রযুক্তি ব্যবহার হলে কৃষকের যেমন লোকসান কমবে, সঙ্গে বাণিজ্যিক কৃষিতে ব্যবসায়ীরা লাভবানও হবে। পুরো অর্থনীতির চিত্রই তখন বদলে যাবে। সরকারও প্রচুর লাভবান হবে।

রেডিয়শনে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, এ প্রসঙ্গে ড. মোফাজ্জল বলেন, পরমাণু বিকিরণ পদ্ধতিতে মোটেই স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। এটা কোনোভাবেই তেজষ্ক্রিয় পদার্থ তৈরি করে না। এটা নিরাপত্তা বলয়ে একটা ক্যাপসুলের মতো থাকবে, প্রটেকশন থাকবে ১০ মিটারজুড়ে, এতে ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা মাটির নিচে থাকবে, যেখানে ব্যবহার হবে জার্মানির প্রযুক্তি। আর এটা করা হবে কানাডাসহ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাগুলোর কারিগরি সহাযোগিতায়।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris