রবিবার

১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ

কম খরচে বেশি ফলনশীল ধান উদ্ভাবন

Paris
Update : শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

এফএনএস : যেখানে আমন ধানের জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৫০ দিন সেখানে মাত্র ১১০ দিনেই কৃষকরা ঘরে তুলতে পারছেন ধান। অর্থাৎ, প্রায় একমাস আগেই এসব ধান উঠছে কৃষকের ঘরে। এটি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত আমন মৌসুমের আগাম জাতের ধান ‘বিনা’। উচ্চফলনশীল হওয়ায় এবছর জাতগুলোর ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। কম সময়ে চাষ করা যায় বলে উৎপাদন খরচও কম। তাই বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প সময়ের জাত বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২০ এবং বিনা ধান-২২ এরইমধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে সারাদেশে।

এসব আগাম জাতের ধান নিয়ে রীতিমতো উৎসব চলছে বিভিন্ন এলাকায়। সূত্রমতে, এসব জাতের বিঘাপ্রতি ফলন প্রায় ছয় টন। যা আমনে চাষ হওয়া অন্য গতানুগতিক জাতের চেয়ে এক থেকে দেড় টন বেশি। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের কারণে দ্রæত ধান কেটে রবিশস্যের চাষ করা যাচ্ছে একই জমিতে, যে জমি আগে ইরি-বোরো পর্যন্ত অনাবাদি থাকতো। এ কারণে বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক। খরাসহিষ্ণু, স্বল্প জীবনকাল ও অধিক ফলনশীল বিনাধান-১৭-এর বাম্পার ফলন দেখে কৃষকরা অভিভ‚ত।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফলিত গবেষণা ও স¤প্রসরাণ বিভাগের প্রধান মঞ্জুরুল আলম মন্ডল বলেন, বিনাধান-১৭ আবাদ করে প্রতিহেক্টর জমিতে ৮ টন ধান পাওয়া যায়। রোপণের ১১০ দিন পরই ধান পেকে যায়। কম সময়ে পাকায় একই জমিতে বিনাধান-১৭ আবাদ করে তিন-চারটি ফসল আবাদ করা সম্ভব। বিনা’র মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, চীন, ইরি এবং বিনা যৌথ গবেষণা করে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে বিনাধান-১৭ উদ্ভাবন করেছে। ধানটি রোগ বালাই সহনশীল, এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার ও অর্ধেক পানি সাশ্রয়ী এবং খরাসহিষ্ণু হওয়ায় আগাম ও অধিক ফলনশীল বিনাধান-১৭-কে ‘গ্রিন সুপার রাইস’ বলা হয়।

আগামীতে ধানটি ‘মেগা ভ্যারাইটি’ হবে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামানবলেন, কম সময়ে অধিক ফলন পাওয়ায় এবং দ্রæত পাকায় আর্থিকভাবে লাভবান হবেন কৃষক। এ ছাড়া দুই ফসলি জমিতে বিনাধান-১৭ আবাদে তিন-চারবার ফসল চাষ করা সম্ভব। দেশব্যাপী এই ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের শস্যভাÐারখ্যাত নওগাঁ জেলায় এবছর ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমিকভাবে বিনা-১৭ জাতের ধান চাষ হয়েছে ১ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে।

তার মধ্যে রানীনগরে ৫২০ হেক্টর, ধামইরহাটে ১২৫ হেক্টর, নিয়ামতপুরে ৫ হেক্টর ও মান্দায় ২০ হেক্টরসহ অন্য উপজেলায় কমবেশি এ জাতটির চাষ হয়েছে। অক্টোবরের ২০ তারিখের মধ্যে প্রায় সবগুলো এলাকায় শেষ হয়েছে এ ধান কাটা। এ প্রসঙ্গে বিনা উপকেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাসানুজ্জামানবলেন, নতুন জাত চাষ করায় এ এলাকায় এখন বোরো লাগানোর আগে প্রায় দুই মাস সময় পাবে কৃষক। আগে আমন কাটার পরে বোরো লাগানোর মাঝের সময় এলাকার সব জমি অনাবাদি থাকতো। এখন রবিশস্য হিসেবে সরিষা, মসুর ডাল, আলু বা তিল চাষ করা যাবে।

রবিশস্য উঠিয়ে আবার বোরো ধান লাগানো যাবে। অর্থাৎ এসব দুই ফসলি জমি এখন তিন ফসল হবে। পাশাপাশি মাটির উর্বরতাও বাড়াবে। তিনি জানান, বিনাধান-১৭ বা ১৬ তে পানি কম লাগার কারণে একে গ্রিন সুপার রাইস নামেও অভিহিত করেছেন অনেকে। আর খরা এলাকায় এ জাতটি আশীর্বাদ হতে পারে। এ দুটি জাতের ধান চাষে ইউরিয়া সার এক-তৃতীয়াংশ ও সেচ ৫০ শতাংশ কম লাগে। এ ধানের জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। এর প্রতি শীষে ২০০-২৫০টি দানা থাকে এবং ফলনও আশাব্যঞ্জক হওয়ায় কৃষকের জন্য এ জাতের ধান চাষ খুবই লাভজনক।

প্রতি বিঘায় প্রায় ২২ থেকে ২৫ মণ ফলন হয়েছে এ ধানের। এ ধান উদ্ভাবন করেছেন বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম নিজেই। তিনিবলেন, এ ধানটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট এটি বন্যা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু। এজন্য চর এলাকায় এ ধান চাষ করা হচ্ছে। এ ধান ২০ থেকে ২৫ দিন বন্যার পানিতে ডুবে থাকতে পারে। চারা পচে গেলেও আবার শিকড় থেকে চারা গজাবে। সেই প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ভবন করা হয়েছে। বিনার এসব নতুন জাত দিয়ে দেশে মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ চিরতরে বিদায় করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করে মহাপরিচালক বলেন, টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

এরই ধারাবাহিকতায় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হচ্ছে বিভিন্ন ফসলের টেকসই ও উন্নত জাত। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূরীকরণসহ সমগ্র দেশের ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে উচ্চফলনশীল বিনা ধান-১৬ এবং বিনা ধান-১৭ সেরা। ফলনে সবচেয়ে সুপার ভ্যারাইটি এ দুই জাত। আবার বন্যা ও জলমগ্নতার জন্য বিনা ধান-১১। এদিকে বিনা বলছে, বিনা ধান-১৬ এর জীবনকাল মাত্র ৯৫-১০০ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ টন (বিঘাপ্রতি ২৪ মণ)। বিনা ধান-১৭ এর জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ দশমিক ৫ টন (বিঘাপ্রতি ২৭ মণ)।

অতীতে আমন ধানের অন্য জাতের জীবনকাল ছিল ১৬০-১৭০ দিন এবং ফলন ছিল বিঘাপ্রতি মাত্র ৪-৫ মণ। পাশাপাশি বন্যা ও খরার সময় আমনের গতানুগতিক ধানগাছ লম্বা হওয়ায় ঢলে পড়তো। সে বিষয়ও খেয়াল রেখে নতুন জাতগুলোর গাছ ছোট করা হয়েছে। বিনা বলছে, জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ (আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজতলা তৈরি করে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করলে ভালো ফসল পাওয়া যায়। তবে জুলাইয়ের শেষ (শ্রাবণের দ্বিতীয়) সপ্তাহ পর্যন্তও বীজতলা করা যায় এসব আগাম জাতের।

ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ জীবনকাল বিশিষ্ট হওয়ায় উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা বছরে দু’টির বেশি ফসল চাষ করতে পারতো না। প্রায় ১৫/২০ বছর আগে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হতো। উত্তরবঙ্গসহ যমুনা পাড়ের অঞ্চলগুলোতে মঙ্গা বা মরা কার্তিক নামে এ সময়টি পরিচিত ছিল। এই মরা কার্তিককে ভরা কার্তিকে রূপান্তর করার জন্য এসব নতুন ধান খুবই কার্যকর হবে।

বিনার আমনের জাতগুলোর জীবনকাল কম হওয়ায় পানি ও অন্য উপকরণ খরচ কম লাগে। তথ্য বলছে, বিনা ধান-১৭ জাতে ইউরিয়া সার এক-তৃতীয়াংশ কম প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ সেচের অর্থ সাশ্রয় হবে। সার্বিকভাবে অন্য জাতের আমনের চেয়ে বিনার জাতগুলোর খরচ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কম। পাশাপাশি অমৌসুমে ধান কাটায় গোখাদ্য হিসেবে ধানের খড়ের সরবরাহ বাড়বে, ভালো দাম পাবেন কৃষক।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris