শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনাকালে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কম কেনায় বিপিডিবির লোকসান কমেছে

Paris
Update : মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০

এফএনএস : করোনাকালে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আশানুরূপ লোকসান কমেছে। নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পর গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে দুই মাসের বেশি সময় সাধারণ ছুটি ছিল। ওই সময় দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ ছিল অফিস-আদালত, কল-কারখানা ও বিপণিবিতানসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কমে যায় বিদ্যুতের চাহিদা। আর চাহিদা কমে যাওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ বিপিডিবিকে কম কিনতে হয়েছে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের বোঝাও কমেছে। অর্থবছরের শেষভাগজুড়ে থাকা করোনার প্রভাবে বিপিডিবির ৯৫ শতাংশ লোকসান কমেছে।

গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসান হয়েছে মাত্র ৯ কোটি টাকা। অথচ এর আগের অর্থবছরেরই প্রতিষ্ঠানটির ১৭৪ কোটি টাকা লোকসান ছিল। যদিও তার আগের বছরগুলোয় প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ছিল আরো বেশি। তার মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৫৪ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৩৪ কোটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা বিপিডিবির লোকসান হয়। বিপিডিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিপিডিবি লোকসানের বোঝা কমাতে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিতে হচ্ছে। সর্বশেষ দুই অর্থবছরে আগের বছরগুলোর তুলনায় লোকসান কম হওয়ার অন্যতম কারণও সরকারের দেয়া ভর্তুকি। তার মধ্যে সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছর ৭ হাজার ৪৩৯ কোটি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর ভর্তুকি বাবদ ৯৫৬ কোটি টাকা দেয়া হলেও তা প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের তুলনায় ছিল সামান্য। তাছাড়া ওই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ডিজেল ও এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপিডিবির বেশি বিদ্যুৎ কিনতে হয়। পাশাপাশি ওই অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামও বেড়ে গিয়েছিল। ওসব কারণে গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিপিডিবিকে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিপিডিবির লোকসান কমলেও বিদ্যুতের চাহিদা না থাকায় অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বড় অংকের অর্থ বিপিডিবিকে গুনতে হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বছরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা দিতে হয়। বিপিডিবি ২০১৮ সালে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে অলস কেন্দ্রগুলোকে ৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দিয়েছে। আর পরের বছর তার পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে কোনো লোকসান হয় না। মূলত ডিজেল ও এইচএফওভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার কারণেই বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের আগে সরকারের পক্ষ থেকে বিপিডিবিকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া হতো। বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে তাতে প্রতিষ্ঠানটির অর্থ সংস্থান হলেও আর্থিক প্রতিবেদনে তা দায় হিসেবে দেখাতে হতো। ফলে ক্রমাগত লোকসানের কারণে একসময় বিপিডিবির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। লোকসানের বোঝা কমাতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) দ্বারস্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বিইআরসির পরামর্শে দুই বছর ধরে সরকার বিপিডিবিকে ভর্তুকি দিচ্ছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তার আগে সরকারের কাছ থেকে সংস্থাটির নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় অর্ধলক্ষ কোটি টাকা। তবে সরকারি-আধাসরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে বিপিডিবির বড় অংকের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। ওসব বিল বছরের পর বছর অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী ৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া বিলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বিপিডিবির।

সূত্র আরো জানায়, বিপিডিবি লোকসান কমাতে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই ডিজেল ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা কমিয়ে দিচ্ছে। তার মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ উৎপাদন করেছিল। তার পরের দুই অর্থবছরে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়। তার মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ বিদ্যুৎ ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে এসেছে। কিন্তু দুই অর্থবছর ধরেই ওই খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তার মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাত্র দশমিক ১৯ শতাংশ বিদ্যুৎ ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে এসেছে।

এদিকে বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ উৎপাদন করেছিল। তার পরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৩১ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ ওই খাত থেকে এসেছিল। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরো কমে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদন কমলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ২৫ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

অবশ্য এ সময়ে উৎপাদনের পাশাপাশি ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাও কমেছে। সরকারি, বেসরকারি, যৌথ উদ্যোগ ও আমদানি মিলিয়ে এ বছরের জুন শেষে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। তার মধ্যে সরকারি ৪৮ শতাংশ, বেসরকারি খাত ৪৩ শতাংশ, যৌথ উদ্যোগ ৩ শতাংশ এবং আমদানি সক্ষমতা ৬ শতাংশ। গেল অর্থবছরে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সবচেয়ে বেশি ১২ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ বিপিডিবির আরো ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ হাজার ২৯৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। নতুন কেন্দ্র যোগ হওয়ার পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫ হাজার ৫০১ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৭০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে।

অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর আগের বছরের তুলনায় বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ দশমিক ৪০ শতাংশ কমেছে। আর আইপিপি কেন্দ্রগুলো থেকে এ সময়ে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বেড়েছে ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে এ সময়ে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ কমেছে ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমলে ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তাছাড়া ২০১১ সালের ৫ মে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৪৬ টাকা। তারপর ২০১২ থেকে গত বছরের পয়লা জুন পর্যন্ত প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬১ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে ছিল। আর ২০১১ সালে ফার্নেস অয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৪২ টাকা। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ টাকা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ফার্নেস অয়েলের দাম অপরিবর্তিত ছিল। অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে ফার্নেস তেলের দাম কমে ৪২ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের ডিজি মোহাম্মদ হোসাইন জানান, ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেই খরচ বাড়বে। যদি চাহিদা বাড়ে তাহলে বাধ্য হয়ে সেগুলো সচল থাকবে। তবে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কম উৎপাদন খরচে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হবে। ফুয়েল মিক্সটাকে করতে হবে সাসটেইনেবল। চাহিদা হয়তো কমেছে, যার প্রভাবে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হয়নি। যদিও এ চিত্র সাময়িক। তবে লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে আনা। পিডিবির লোকসান কমা প্রসঙ্গে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন জানান, লোকসান কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী কিছু ফল ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। তবে লোকসান কমার সুনির্দিষ্ট কারণ আগামী বছরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা সম্ভব হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris