সোমবার

২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
একাদশে ভর্তি ১৫-২৫ জুলাই ক্লাস শুরু হবে ৩০ জুলাই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে আশঙ্কা কেটে গেছে বাংলাদেশি টাকা পাচার করতে গিয়ে সিপিএম নেতা গ্রেফতার শিল্প গড়ে উঠুক, বর্জ্য যেন নদীতে না পড়ে : প্রধানমন্ত্রী প্রচার প্রচারণায় ব্যাস্ত পবার চেয়ারম্যান প্রার্থী ওয়াজেদ আলী খান রাজশাহীতে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ধান উৎপাদন নাবিল গ্রুপ প্রেজেন্টস ৮ম আর ইউ সি সি জব ফেয়ার অনুষ্ঠিত স্বাচিপ রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত রাজশাহী জেলা পরিষদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কাজের শুভ সূচনা মোহনপুরে ভোক্তা অধিকারের অভিযান ৩ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

টানেলের যুগে বাংলাদেশ

Paris
Update : রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩

এফএনএস
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বহুল কাক্সিক্ষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। টানেল উদ্বোধনের পর আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ উদ্যাপন করা হয়। এ সময় উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। টানেল উদ্বোধনের দৃশ্য জনসভাস্থলে বসানো বিভিন্ন ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হয়। মাইকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক গানের সুর। সকালে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যান। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িবহর টানেল এলাকায় প্রবেশ করে। টানেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারা টোল প্লাজায় যান। সেখানে টোল প্লাজা কমপ্লেক্স ও টানেলের স্মার্ট মনিটরিং কক্ষ পরিদর্শন করেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী পৌনে ১২টায় পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টোল প্লাজায় টোল দিয়ে টানেল হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে যাত্রা করেন। এরপর সেখানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে টোল নেন ঝুমুর আক্তার। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করেন। প্রথম যাত্রী হিসেবে টানেলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। এরপর তাঁর গাড়িবহরে থাকা অন্য গাড়িগুলো টোল পরিশোধ করে। ঝুমুর আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, টানেলে প্রথম যাত্রী প্রধানমন্ত্রী টোল দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে টোল নিতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। রোববার সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দেওয়া হবে। টানেলের নিরাপত্তায় লাগানো হয়েছে অত্যাধুনিক ১১০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। আনোয়ারা প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেন্টার। যেখান থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে পুরো টানেলে নজরদারি চালানো হবে। টানেলের প্রতিটি টিউবে রয়েছে লম্বা একটি হিট সেন্সর। যেখানে অগ্নিকাণ্ড বা কোনো কারণে তাপ লাগা মাত্র অটোমেটিক সিসিটিভি ক্যামেরা ঘটনাস্থলের দিকে ঘুরে যাবে। এ ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা হলে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি চালানো হবে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) আগামী পাঁচ বছর টানেলের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করবে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাদের কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। টানেলের ভেতরে যেকোনো সমস্যায় দ্রুত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় সেই টিম ছুটে যাবে। তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশ নিরাপত্তার কাজ করবে। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশ কাজ করবে যানবাহন চলাচল নিয়ে। অগ্নি দুর্ঘটনায় ঠেকাতে টানেলের দুই প্রান্তে স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির দুটি ফায়ার স্টেশন। কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) স্থাপনা বিবেচনায় নিরাপত্তায় থাকবে টানেল। প্রবেশমুখে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে চারটি অত্যাধুনিক স্ক্যানার। বর্তমানে দুই প্রান্তে দুটি স্ক্যানার বসানোর হয়েছে। স্ক্যানার দিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলোতে চালক ও পণ্য রাখার অংশ আলাদা রঙের রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এ ছাড়া টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী বাস, কার, মাইক্রোবাস অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। ইউভিএসএস দিয়ে যানবাহনের নিচের অংশে বিস্ফোরকজাতীয় সরঞ্জাম আছে কি না, তা যাচাই করা হবে। সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু টানেলের। প্রায় সাড়ে ৪ বছরের বেশি সময় বা ৫৬ মাস পর বাস্তবে রূপ পেল সেই স্বপ্নযাত্রা। খরস্রোতা কর্ণফুলীর তল ছুঁয়ে টানেল নির্মাণের ফলে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে- তা অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বঙ্গোপসাগর তীরের উপজেলা আনোয়ারাবাসীর। শুধু আনোয়ারা নয় দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়েছে। শিল্পকারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ার পাশাপাশি কর্ণফুলীর পূর্বপ্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। টানেল নির্মাণে আগ্রহ দেখানো চীন হঠাৎ করে বেঁকে বসে প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক দূরদর্শীতায় রাজি হয় চীন সরকার। করোনা, বিশ্বমন্দাসহ প্রতিবন্ধকতাও থামিয়ে রাখতে পারেনি দেশের এই মেগা প্রকল্পের কাজ। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত একমাত্র টানেল আজ বাস্তব। নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে প্রকৌশলগত অনেক সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছে প্রকৌশলীদেরও। বিদেশি প্রকৌশলীদের পাশাপাশি এ প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন দেশের ৪৪ জন প্রকৌশলী। যারা প্রতিনিয়ত কাজ করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়নে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে শ্রমিকদের আনা হয়েছিল। প্রথম দিকে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করেছে। শেষ সময়ে চিনের প্রায় ৭০০-৮০০ জন টানেল নির্মাণে কাজ করেছিল। সাধারণত শক্ত মাটিতে বোরিং করা সহজ হলেও, মাটির ভিন্নতার কারণে বোরিংয়ে চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে তাদের। ফলে টানেলের প্রথম টিউবের কাজ শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ১৭ মাস। কিন্তু মাত্র ১০ মাসেই শেষ হয় দ্বিতীয় টিউবের কাজ। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ০.২২ জি (ভূমিকম্প মাপার একক) থেকে ০.২৮ জি মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে টানেলের অবকাঠামো। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা সাড়ে ৭। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় টানেলের দুই টিউবের দুই প্রান্তে দুটি করে চারটি ফ্লাড গেট বন্ধ রাখা হবে। এতে টানেলের ভেতরে পানি ঢুকতে পারবে না। টানেল নির্মাণে প্রকৌশলগত সমস্যা সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, দেশের প্রকৌশলীদের নিয়ে টানেল করা খুব দুরুহ ব্যাপার ছিল। যেহেতু আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা নতুন, আমরা দেখে দেখে শিখেছি। পাশাপাশি কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সমস্যা অতিক্রম করেছি। প্রথম টিউবের খনন কাজ যখন শুরু হয়, প্রায় ৫ শতাংশ বোরিং করার পর বিশেষজ্ঞ দল লক্ষ্য করেন বোরিং মেশিনটির উর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রবণতা। নকশা অনুযায়ী, যে রেটে মেশিনটি নিচের দিকে যাওয়ার কথা- সেভাবে না গিয়ে উপরের দিকে উঠছে। মূলত নরম মাটির কারণে এ সমস্যা হয়েছে। এ ছাড়া টানেলের কাজ যখন নদীর গভীরে গিয়ে পৌঁছায়, তখন বোরিং মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে। ফলে আমাদের ৪ মাসের মত কাজ বন্ধ রাখতে হয়। পরে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এসে বিষয়টি সমাধান করে। মূলত টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) এর প্রথম অংশের মেইন শিল্টের পুরুত্ব কম হওয়ায় এ সমস্যা হয়। তিনি বলেন, টিবিএম মেশিনের মেইন শিল্টের পুরুত্ব ছিল ১৩ মিটার। দ্বিতীয় টিউবে খনন কাজের সময় এ শিল্টের পুরুত্ব বাড়ানো হয়। ফলে এ টিউব খননে আর সমস্যায় পড়তে হয়নি। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটি নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে। পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট। টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ হয়েছে। টানেল নির্মাণের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারা উপজেলার চিত্র। পরিণত হচ্ছে উপশহরে। তবে সেই উপশহর যেন পরিকল্পিতভাবেই গড়ে তোলা হয়, এমন দাবি স্থানীয়দের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় আসা আনোয়ারা উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা এ দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, একজন নাগরিকের মৌলিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে একটি উপশহরে। আনোয়ারাকে উপশহর ঘোষণা করার পর সেখানকার নাগরিকদের যদি সেবা নিতে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হয় তাহলে সেটি উপশহর হবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে উপশহর গড়ে তুলতে হবে। শেখ আহমেদ নামের এক বৃদ্ধ বলেন, আমার বয়স ৭০ বছর। ছোটবেলা থেকে দেখছি আনোয়ারা উপজেলা অবহেলিত। অথচ শহরের কাছের একটি উপজেলা এটি। কিন্তু শহরের কোনো সুযোগ সুবিধা আমরা পেতাম না। টানেল নির্মাণের ফলে এ উপজেলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। যোগাযোগে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বৈরাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে আনোয়ারা কেবল উপশহর নয়, একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক হাবে পরিণত হবে। অনেক বড় বড় কোম্পানি এখানে তাদের কারখানা নির্মাণ করছে। সেখানে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমিনুল ইসলাম নামের এক স্কুল শিক্ষক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে পাল্টে যাচ্ছে আনোয়ারার চিত্র। বর্তমানে সিইউএফএল, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন ও পারকি সৈকত রয়েছে আনোয়ারায়। এই টানেল আনোয়ারার আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আনোয়ারার চাতরী ইউনিয়নের বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, টানেল ঘিরে ইতোমধ্যে আমাদের এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জমি কেনা শুরু করেছে। জমির দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। শুধু আনোয়ারা উপজেলা নয়, টানেল নির্মাণের ফলে কর্ণফুলী ও পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র পাল্টে যাবে বলে জানান স্থানীয় নেতারা।

 


আরোও অন্যান্য খবর
Paris