শনিবার

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝুঁকিতে থাকা শিশুারা

Paris
Update : রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সিফাত শাহারিয়ার কিয়াম : সামাজিক অসচেতনতা, কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দারিদ্রতাসহ নানা কারণ আমাদের সমাজের শিশুরা ঝুঁকিতে রয়েছে। এই যান্ত্রিক শহরে প্রাণ খুলে শ্বাস নেবার জন্য কয়েকদিন আগে পদ্মা নদীর তীরে গিয়েছিলাম। নদী তীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পার্কের ছাউনির নিচে বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ চোখের সামনে একগুচ্ছ ফুল চলে আসলো। কিছুটা বিস্মিত হয়ে দেখলাম আট বা নয় বছর বয়সী রাতুল নামের এক শিশুর হাতে অনেকগুলো ফুল এবং সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “একটি ফুল নেন পিলিজ, খিদা লাগসে, ভাত খামু।” তার হাতে এক শত টাকার নোট দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি পড়ালেখা করো না?” উত্তরে রাতুল বলল, “ঠিকমতো তো খাইতেই পাইনা, আমরা গরিব মানুষ। ফুল বিক্রি করেই দিন কাটে আমাদের। রাত হইলে ফুটপাতে বা রেল স্টেশনে গিয়ে ঘুমাই।” তার মত এরকম রাস্তায় বসবাস করা শিশু বা পথ শিশু আমাদের সমাজে অনেক আছে যারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া আমার ছোট বোন নুসরাত যখন বলে আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই তখন তার সমবয়সী আরেকজন শিশু দু মুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় ফুল বিক্রিতে ব্যস্ত, পড়ালেখা তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা। সেই ফুল বিক্রি করা শিশু রাতুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার স্বপ্ন কি?” উত্তরে যা বলেছিল তা আমি হয়তো কোনদিন ভুলবো না। তার স্বপ্ন হলো প্রতিদিন পেট ভরে ভাত খেতে চাই। কি অদ্ভুত! তার সমবয়সী ছেলে মেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে আপন স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে কিন্তু এসব শিশুদের স্বপ্ন তাদের দারিদ্রতার বেড়াজালে বন্দী। তারা ভাবতেই পারে না যে সেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। দেশের সেবা করতে পারে। ভাববেই বা কিভাবে? কেউ তো তাদের সপ্ন দেখাইনি। বরং তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কাজের বোঝা। অর্থ আয়ের জন্যে দরিদ্র পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করছে না। সামাজিক অসুস্থতা এবং দরিদ্রতার রশি এসব শিশুদের এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালোবাসা তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে কাগজের তৈরি কিছু অর্থের জন্য। এভাবে চলতে থাকা শিশুশ্রমের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত প্রস্থ হচ্ছে তেমনি তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে তারা পড়ালেখা করে দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে ইন শা আল্লাহ ।সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় দেখা যায় পথ শিশুদের খাবার বিতরণ করতে। এই এক বেলা খাবার দিয়ে কি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দার উন্মোচন করা সম্ভব হবে? কখনোই না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে গৃহীত এবং ১৯৯০ সালে আইন আকারে প্রণীত হওয়া শিশু অধিকার সনদের ৫৪ টি ধারায় শিশুর অধিকার নিশ্চিতের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ১৮৭ টি দেশের মধ্যে প্রথম যেসব দেশ এই চুক্তি সাক্ষর এবং অনুমোদন করে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম হলে বাংলাদেশের অনেক শিশু এখনো অধিকার বঞ্চিত। প্রথমে শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজ কি দেখতে পায় না এসব অবহেলিত শিশুদের?
আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের বোঝা মনে করা হয়। পরিবারে কোনো প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিলে বাবা-মা তাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেন অথচ সঠিক চিকিৎসা এবং পরিচর্যার মাধ্যমে এসব শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ইন শা আল্লাহ । ইতিহাসে এমন অনেক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে যারা নিজ যোগ্যতা ও প্রতিভার মাধ্যমে বিশ্বের মধ্যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একটু সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধী শিশুরা সকল পাহাড় সমান প্রতিবন্ধকতা জয় করে সফলতার কাতারে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে পারবে ইন শা আল্লাহ। আমাদের সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করা এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের অনেকের হাত নেই বা পা নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা যখন পবিত্র কোরআনের হাফেজ হয়ে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের প্রতিবন্ধী হলে বিদ্রুপ করে সমাজের বোঝা মনে করা মূর্খতা ব্যতীত অন্য কিছু নয় । ইউনিসেফ বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের শতকরা ৮২ দশমিক ৯ ভাগ শিশু পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় এবং শতকরা ৪৯ দশমিক ৮ ভাগ শিশু কাজের জায়গায় হয়রানির শিকার হয়। আমাদের সমাজে বাসা বাড়িতে শিল্প কারখানায় বিভিন্ন শিশু কাজ করে থাকে। দুঃখের বিষয়, আমরা নিজেদের সন্তানকে বসুন্ধরা সিটি কিংবা যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে ঈদের জামা কিনে দিতে পারলেও অল্প কিছু টাকা খরচ করে বাসায় কাজ করা শিশুটির হাতে একটি নতুন জামা দিয়ে বলতে পারি না, “এই নাও তোমার ঈদের উপহার।” ধিক্কার জানাই নিজেদের প্রতি,ধিক্কার জানাই বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করা শিক্ষিত সমাজের প্রতি যে সমাজে নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুরা এখনও অনিরাপদ।বাসা বাড়িতে কর্মরত অনেক শিশুই নির্যাতনের শিকার হয় ।তাদের গায়ে হাত তোলার আগে ভাবা উচিত নিজেদের সন্তানের গায়ে যদি কেউ আঘাত করে তবে কেমন অনুভূতি হবে । শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধে গণমাধ্যম,সুশীল সমাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সহ সকলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই আমরা শিশুদের একটি সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারবেন ইনশাল্লাহ.
নগরায়ন ও শিল্পায়নের এই যুগে অনেক শিশুর কাছে তার পৃথিবী চার দেয়ালে আবদ্ধ। ভোরবেলায় শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে সোনালী সূর্যের আলো গায়ে মাখার কথা তাদের কল্পনাতেও আসে না। না আসাটাই স্বাভাবিক কেননা শিশুদের হাতে মোবাইল, ট্যাব তুলে দিয়ে আমরাই তাদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে তুলেছি। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার আনন্দ আর এন্ড্রয়েড ফোনে খেলা পাবজি বা ফ্রী ফায়ার গেম খেলার আনন্দ কখনোই এক হতে পারে না। বরং নেট দুনিয়ায় অবাধ বিচরণ শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য হুমকি স্বরূপ।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান ছোটমনি নিবাস সহ শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও কেন আজ পথ শিশুদের হাতে বই খাতা থাকার পরিবর্তে থাকে বিক্রি করার জন্য ফুল? আমরা সবাই চাইলে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করে তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারবো ইন শা আল্লাহ। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলায় কোনো শিশু অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। শিশু অধিকার নিশ্চিতে সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিন্তু সঠিক সমন্বয় এবং দায়িত্বের প্রতি আন্তরিকতা না থাকলে সেসব পথ শিশুদের সোনালী স্বপ্নের বীজ হয়তো কোনদিনই অঙ্কুরোদগমিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। অধিকার বঞ্চিত শিশুরা অল্প বয়সে শ্রমে যুক্ত হওয়া এবং নৈতিক শিক্ষা না পাওয়ায় পরবর্তীতে উগ্রবাদী হয়ে যাচ্ছে। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এখন চোখে পড়ে কিশোর গাঙের অপকর্ম। শিশু অধিকার নিশ্চিত করতে না পারায় এই কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। শুধু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, নীতিমালা প্রণয়ন করে বসে থাকলে হবে না, প্রতিটি শিশুকে নিজের সন্তান, ছোট ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখে তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সাভাবিক, নিরাপদ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারগুলোকে বোঝাতে হবে তাদের সন্তান স্কুলে গেলে,শিক্ষিত হলে তা সকলের জন্যই কল্যাণকর। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ এবং সকলের সহযোগিতা পেলে ঝুঁকিতে থাকা অবহেলিত শিশুরাই আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে পারবে ইন শা আল্লাহ। অনেকেই ঝুঁকিতে থাকা অধিকার বঞ্ছিত শিশুদের খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন,যারা এদের খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, লজ্জা তো আপনাদের হওয়া উচিত যারা শিক্ষিত,বৃত্তশালী হয়েও এসব শিশুদের হাতে বই খাতা আর মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে পারেন নি। শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধুই অর্থ উপার্জন? কখনোই না। আপনার অর্জিত শিক্ষা যদি আপনাকে সামাজিক, মানবিক, নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যাক্তি রূপে গড়ে তুলতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা অর্থহীন ।আমাদের দেশে এমন অনেক শিল্পপতি রয়েছেন যারা একটু চেষ্টা করলে হাজারো অধিকার বঞ্চিত শিশুর ভবিষ্যতের কালো মেঘ দূর করে সোনালী সূর্য উদিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারবেন ইন শা আল্লাহ। সে সব বিত্তশালী মানুষের প্রতি বিনীত আহ্বান আপনার আশেপাশের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সচেতন হউন। আমরা সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলে আমাদের দেশের সকল শিশুর অধিকার নিশ্চিত করে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে ইনশা আল্লাহ। আমরা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যখন ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে করণীয় কি তা আমাদের সভা, সেমিনারের আলোচ্য বিষয় হবে না, বরং এক সময় ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ জীবন নিশ্চিতকরণে আমাদের সফলতার গল্প বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হবে ইনশাল্লাহ! (লেখক একজন শিক্ষার্থী)


আরোও অন্যান্য খবর
Paris