সোমবার

২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বজনীন পেনশনের চাঁদা জমা দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ

Paris
Update : সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩

এফএনএস
শাকিলা আফরোজ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে প্রগতি স্কিমে নিবন্ধন করে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে গিয়ে ধাক্কা খান। দেখেন, কিস্তি জমা দিতে গিয়ে তাকে আরও খরচ করতে হবে। যাদের সোনালী ব্যাংকে হিসাব আছে, তাদের কোনো টাকা লাগছে না। কিন্তু অন্য ব্যাংক থেকে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগও আপাতত নেই। অন্য যে উপায়গুলো আছে, তার মধ্যে একটি হল মোবাইলে আর্থিক সেবার কোম্পানি বা এমএফএস ব্যবহার অথবা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার। এমএফএস ব্যবহার করে পাঁচ হাজার টাকার কিস্তি জমা দিতে গেলে বাড়তি মাসুল আসে ৪০ টাকা। বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, সেলফিন, ওকে ওয়ালেট আর ট্যাপ- সব জায়গায় একই হার। তবে কার্ডের ক্ষেত্রে টাকার হেরফের আছে। ডাচবাংলা ব্যাংকের নেক্সাস কার্ড ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকায় মাসুল আসবে ৭৫ টাকা, ভিসা ও মাস্টার্স কার্ডে এটি ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা আর এমেক্স কার্ড হলে কাটবে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। শাকিলা আফরোজের বয়স এখন ৩৫। তিনি টাকা জমা করতে পারবেন ২৫ বছর। যদি এমএফএস ব্যবহার করে প্রতি মাসে চাঁদার টাকা জমা করেন, তাহলে এই ২৫ বছরে টাকা জমা করতেই তার খরচ হবে ১২ হাজার টাকা। যদি ভিসা ও মাস্টার্স কার্ড ব্যবহার করেন, তাহলে ২৫ বছরে তার যাবে ২৬ হাজার ২৫০ টাকা। আর যদি এমেক্স কার্ড ব্যবহার করেন, তাহলে তার মোট খরচ হবে ৩৩ হাজার ৭৫০ টাকা। এই বাড়তি খরচ কাউকে করতে হত না, যদি অন্যান্য ব্যাংকেও পেনশন কর্তৃপক্ষের হিসাব থাকত বা অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইনে বিইএফটিএনে (বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক) টাকা স্থানান্তরের ব্যবস্থা থাকত। কারণ, এই ব্যবস্থায় টাকা পাঠাতে কোনো খরচ হয় না। কর্মজীবন শেষে অবসরে মানুষকে স্বস্তি দিতে পশ্চিমা বিশ্বে বহু আগে থেকেই আছে সর্বজনীন পেনশন সুবিধা। বাংলাদেশে এ সুবিধা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ছিল এতদিন। গত ১৭ অগাস্ট সরকার সবার জন্য এই সুবিধা নিয়ে আসে। মোট চারটি স্কিম নিয়ে এসেছে সরকার। চারটিতেই যত বেশি বছর ধরে টাকা জমা করা হবে, পেনশন তত বেশি হবে। যেমন কেউ যদি ১৮ বছর থেকে টাকা জমানো শুরু করে, তাহলে মাসে কেবল দুই হাজার টাকা করে জমা করলে তার পেনশন হবে মাসে প্রায় ৬৯ হাজার টাকা। কিন্তু মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ৩০ বছর জমালেও ওই পরিমাণ পেনশন আসবে না। পেনশনের চাঁদার টাকা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে সশরীরে জমা করার সুযোগ আছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকে অন্য ব্যাংক থেকে স্থানান্তরের সুযোগ না থাকায় বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে এর স্কিমধারীদের। কেন অন্য ব্যাংককে যুক্ত করা হয়নি, এই প্রশ্নে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমরা সোনালী ব্যাংককে বলে দিয়েছি ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি ব্যাংককে পেমেন্ট সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করতে। তারা সে অনুযায়ী কাজ করছে। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে চাঁদার টাকা পরিশোধের সুযোগ সৃষ্টি হবে।” সর্বজনীন পেনশন সুবিধা না থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন ও বহুজাতিক বীমা কোম্পানি আলিকো পেনশন সুবিধা দিয়ে থাকে। সেখানে ৫৫ বছর পর্যন্ত টাকা জমা করলেই তিনি আজীবন পেনশন পান। আর ১২ বছর পেনশন ভোগের আগে মারা গেলে তার নমিনি ১০ বছর পেনশন পান। দুটি স্কিমেই যে কোনো ব্যাংক থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধা আছে। এমনকি ব্যাংক হিসাব দিয়ে দিলে স্বয়ংস্ক্রিয়ভাবে তা কেটে নেয় আলিকো। সর্বজনীন পেনশনে এই ধরনের কোনো পদ্ধতি রাখা হয়নি। প্রতিবার টাকা জমা করতে হলে কাউকে সোনালী ব্যাংকের শাখায় বা ওয়েবসাইটে (িি.িঁঢ়বহংরড়হ.মড়া.নফ) লগইন করে কার্ড বা এমএফএস ব্যবহার করে টাকা জমা করতে হবে। অন্য ব্যাংক থেকে স্থানান্তরের সুবিধা না রাখায় চাঁদা জমা দিতে গিয়ে বাড়তি খরচের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, “দিন যাবে আর নতুন নতুন সুযোগ সবিধা যোগ হবে। অন্যান্য ব্যাংকের অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করেও যেন অনলাইন টাকা জমা দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।” সর্বজনীন পেনশন সুবিধা তো কয়েক বছর ধরে চিন্তা ভাবনার পর করা হয়েছে। শুরুতেই কেন অন্যান্য ব্যাংককে যুক্ত করা গেল না বা অন্য ব্যাংক থেকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখা গেল না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ রকম বড় ধরনের একটি উদ্যোগে শুরু থেকেই সব সুবিধা থাকে না। ধীরে ধীরে এগুলো যুক্ত করতে হয়। আমরা এখন ধীরে ধীরে সেই দিকেই আগাচ্ছি।” “চাইলেই শুরুতে সব কিছু সাবলীল করা যায় না। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেটার পূর্ণতা পায়,” বলেন তিনি।
আগ্রহ খুব বেশি নয় : সর্বজনীন এই পেনশন সুবিধা নিয়ে খুব বেশি সাড়া পড়েছে এমনটি নয়। উদ্বোধনের প্রথম দিনে ১ হাজার ৬০০ নাগরিক চাঁদা দিয়ে পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি দিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার আবেদন জমা পড়ছে। আর তাদের বেশিরভাগেই প্রগতি স্কিমটি নিচ্ছেন, অর্থাৎ বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। সামাজিক মাধ্যমে বহুজন পেনশন স্কিম না নেওয়ার কারণ হিসেবে সরকারি পেনশন সুবিধা চালু করতে হয়রানি ও ভোগান্তির শঙ্কার কথা বলেছেন। টাকা জমা করলে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের কথাও তুলছেন কেউ কেউ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো নতুন কোনো বিষয় এলে শুরুতে মানুষ একে অবিশ্বাস করে। শুরুতে অল্প কিছু মানুষ নতুন কিছুকে গ্রহণ করে এবং তাকে দেখে অন্যান্যরা এগিয়ে আসে। এ জন্য নতুন কোনো কিছু সংযোজন করার ক্ষেত্রে মানুষের এই বৈশিষ্ট্যটি বিবেচনায় নিয়ে একটি যোগাযোগ কৌশলও গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিমে এমন কিছু করা হয়নি। সরকারি উদ্যোগে এর কোনো প্রচারে ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “কোনো প্রকল্প সরকারপ্রধান যখন উদ্বোধন করেন, তখনই তার একটা বড় প্রচার হয়ে যায়। সর্বজনীন পেনশন স্কিমও প্রাথমিক প্রচারে জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে। তবে এর একটা ধারাবাহিক প্রচার থাকা প্রয়োজন। কারণ অব্যাহত প্রচার না থাকলে মানুষ একসময় সেটা ভুলতে বসে। “এক্ষেত্রে সরকারের উচিত গণমাধ্যমগুলো সহযোগিতা নিয়ে পেনশন স্কিমের আরও প্রচার চালানো। তবে আমার মনে হয়, সেটা সরকারের পরিকল্পনায়ও রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সরকারের প্রচার সেল রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার চালিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে যে, এই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। সরকারও এখান থেকে উপকৃত হবে।” প্রচারে উদ্যোগ নেই কেন, এই প্রশ্নে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমরা প্রচারণার কর্মপরিকল্পনা নিচ্ছি। খুব শিগগির আপনারা দেখতে পাবেন।”
পেনশনের খুঁটিনাটি : সরকার যে স্কিম এনেছে, তাতে ১৮ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষরা টাকা জমা করতে পারবে। চাঁদাদাতাদের বয়স ৬০ পূরণ হলে তিনি পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি চাকরিজীবীদের মতো এখানে পেনশন চালু করার কিছু নেই। কারও বয়স ৬০ পূর্ণ হলে তার ব্যাংক হিসাব বা এমএফএস হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে টাকা। পেনশনদাতা প্রতি মাসে টাকা পাবেন আজীবন। তবে তিনি মারা গেলে তার নমিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা পাবেন। যদি পেনশনগ্রহীতা ৭৫ বছর পর্যন্ত বাঁচেন, তাহলে নমিনি কোনো টাকা পাবেন না। তিনি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার যত বছর বা মাস আগে মারা যান, তত বছর পাবেন তার নমিনি। যে চারটি স্কিম নেওয়া হয়েছে তাতে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীরা মাসে পাঁচ হাজার, সাড়ে সাত হাজার বা ১০ হাজার টাকা জমাতে পারবেন। বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আনা প্রগতি স্কিমে জমানো যাবে মাসে দুই হাজার, তিনি হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা। স্বকর্মে নিয়োজিত বা অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের সুরক্ষা স্কিমে মাসে জমানো যাবে পারবেন এক হাজার, দুই হাজার্, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে। একেবারে প্রান্তিক মানুষদের জন্য আনা সমতা স্কিমে মাসে জমা পড়বে এক হাজার টাকা। এর মধ্যে পাঁচশ টাকা দেবে সরকার। টানা ৪২ বছর প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করলে পেনশন হবে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা। পাঁচ হাজারে তা হবে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা। টানা ৪২ বছর কেউ তিন হাজার টাকা জমালে পেনশন হবে এক লাখ ৩ হাজার ৩৯৬ টাকা, দুই হাজার করে জমালে পেনশন হবে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা আর এক হাজার করে জমালে তা হবে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। এই টাকা যেমন প্রতি মাসে জমা করা যাবে, তেমনি প্রতি তিন মাসে বা ছয় মাসে বা ১২ মাসে একবার জমা করা যাবে। আর্থিক সংকটে কখনও টাকা জমার সক্ষমতা হারালে কিস্তি জমা সর্বোচ্চ এক বছর স্থগিত রাখার আবেদন করা যাবে। পেনশন পাওয়ার যোগ্য অর্থাৎ ৬০ বছর হওয়ার আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি লাভসহ টাকা ফেরত পাবেন। তবে নমিতি পেনশনগ্রহীতার নামে টাকা জমা করতে পারবেন না। কেউ নিখোঁজ হলে নমিনি তার নামে সাড়ে সাত বছর পর্যন্ত টাকা জমা করতে পারবেন।
কোথায় বিনিয়োগ হবে : পেনশন পেতে যে টাকা জমা পড়বে, তা অলস বসিয়ে রাখবে না সরকার। সেগুলো বিনিয়োগ করা হবে, তবে এমন কোথাও বিনিয়োগ হবে না, যা ঝুঁকিপূর্ণ। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমরা অবশ্যই অধিক লাভজনক ও নিরাপদ স্থানে বিনিয়োগ করব। প্রাথমিকভাবে সরকারের সভরেইন বন্ডের কথা আমরা চিন্তা করে রেখেছি। “এর বাইরে বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। যেমন সরকার যদি আরেকটি পদ্মা সেতু বানায়, অথবা অন্য কোনো সেতু বা অন্য কোনো বড় অবকাঠামো বানায় সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

 


আরোও অন্যান্য খবর
Paris