মঙ্গলবার

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কর্তন করা হলো রাজশাহী বনবিভাগের ১৫০ জ্যান্ত গাছ!

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২

শাহানুর রহমান রানা : সামাজিক বন বিভাগের আওতাধিন রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়াস্থ ফরেস্ট থেকে প্রায় ১৫০ এর অধিক পুরোনো ও দামি জ্যান্ত গাছ কর্তন করে স্থানটিকে বৃক্ষ শূণ্য করে ফেলা হলো। পরিবেশ ভারসাম্য বিনষ্ট করার ফলে নগরীর সচেতন ব্যক্তি ও পরিবেশবাদিরা চরমভাবে ক্ষোপ প্রকাশ করেছেন। পুরাতন ও জ্যান্ত দামি সেই গাছগুলো কর্তন করা হচ্ছে সেখানে আরবোরেটুম (এমন একটি জায়গা যেখানে প্রদর্শনীর জন্য গাছ এবং গুল্ম চাষ করা হয়) ও নার্সাারি তৈরি করা ছাড়াও নির্মাণ করা হবে বন সংরক্ষক এর জন্য একটি বাসভবন ও অফিস বলে জানান উক্ত কার্যালয়ের একটি সূত্র। জ্যান্ত গাছগুলো কর্তনের ফলে ঐ এলাকায় এখন থেকে বিরাজ করবে অত্যাধিক তাপদাহের পাশাপাশি দেখাদেবে অক্সিজেন স্বল্পতার।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর অতিমাত্রায় স্থানটি জুড়ে গ্রিন হাউস এফেক্টের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে বৃক্ষ স্বল্পতার কারণে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। এছাড়াও গাছের অভাবে বৃদ্ধি পাবে বায়ুদূষণের মতো ক্ষতিকর বিষয়টিও। পরিবেশ রক্ষায় গাছপালার ভূমিকা যে সর্বাধিক তা বলাই বাহুল্য। উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে, অন্য কোনো প্রাণী নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদ কার্বোহাইড্রেট নামক মৌলিক খাদ্য উপাদান প্রস্তুত করে। তারপর পর্যায়ক্রমে তার রূপান্তর ঘটে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে স্থানান্তরিত হয়ে শক্তির জোগান দেয়। প্রত্যেক প্রাণীই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শক্তির জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল, তা সে মাংসাশী হোক বা নিরামিষাশিই হোক। তাই উদ্ভিদ হলো খাদ্য উৎপাদক আর বাকি সব প্রাণীই ভক্ষক। এককথায় ভক্ষককে জীবিত রেখে ধ্বংস করা হলো উৎপাদকদেরকে।


নগরীর শালবাগানস্থ সামাজিক বন বিভাগ কার্যালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রায় ১৫০টি পুরাতন ও দামিদামি বড় গাছ দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। উক্ত কর্তনকৃত গাছগুলোর মধ্যে ছিল বিশ থেকে ত্রিশ বছরের পুরনো অনেক নামিদামি গাছ। দরপত্রের মাধ্যমে গাছগুলো যৌথভাবে কিনেছেন, মান্দার ঠিকাদার কাদের, দিনাজপুরের সোবহান, রংপুর এলাকার আকতার ও রাজশাহীর হায়দার নামে ঠিকাদার। পুরাতন নামিদামি সেই গাছগুলো কর্তন করা হচ্ছে সেখানে আরবোরেটুম (এমন একটি জায়গা যেখানে প্রদর্শনীর জন্য গাছ এবং গুল্ম চাষ করা হয়) ও নার্সাারি তৈরি করা ছাড়াও নির্মাণ করা হবে বন সংরক্ষক এর জন্য একটি বাসভবন ও অফিস বলে জানান উক্ত কার্যালয়ের একটি সূত্র। উক্ত কর্তনকৃত গাছগুলোর মধ্যে আছে, সেগুন, মেহগণি, ইউকেলিপটাস, শিশু ও গর্জন। কার্যালয় থেকে আরো জানাগেছে, কর্তনকৃত গাছগুলোর ফাঁকা স্থানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা লাগানো হবে। এবং সেগুলো বিক্রি করা হবে ক্রেতাদের কাছে। কিন্তু চারাগাছ লাগানোর জন্য যদিওবা প্রায় ১১ একর বিলাশাকৃতির ঐ ফরেস্টের দক্ষিণ দিকের পুরো জায়গা জুড়ে রয়েছে চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা। যেখানে বিগত কয়েক বছর ধরে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির চারা উৎপাদনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এরপরেও প্রায় দেড়শ নামিদামি গাছ কোন অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্যে কর্তন করা হলো সেটি এখন সচেতন ব্যক্তি ও পরিবেশবাদিদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। উল্লেখ্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ পুরস্কার দেশের মানুষের জন্যও সম্মানের বিষয়। বর্তমানে পরিবেশ সচেতনতা শিক্ষার এক অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হতে চলেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের দেশেও পরিবেশবিদ্যা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। শিক্ষার প্রারম্ভিক স্তর থেকেই পরিবেশ বিদ্যা শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও উপলব্ধি করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার অপরিহার্যতা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে তোলার ব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে সমস্ত দেশ জুড়েই। কিন্তু, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের পকেট ভারি করার অসৎ অভিপ্রায়ে বৃক্ষ নিধন করে সেখানে নামমাত্র আর্টিফিয়াল বা যান্ত্রিক সেবা তৈরি করছে প্রায় প্রতিনিয়তই। এদিকে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে রাজশাহী নগরীতে ২০১৫ সালে গঠিত হয়েছিল ‘নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠণ। একাধিকবার নতুন নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হলেও বাস্তবে নেই উক্ত সংগঠণের তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা বলে মন্তব্য সচেতন ব্যক্তিদের। ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি থাকলেও সেটি যেনো শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানাগেছে, বিগত দুই বছরে নগরায়ন, রাস্তা সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রায় সাড়ে চার হাজার গাছ কর্তন করে ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু, এতো কিছুর পরেও ঐ সকল পরিবেশবাদি সংগঠণের নেই তেমন কোন চোঁখে পরার মতো ভূমিকা বলে মন্তব্য অনেকের। বিষয়গুলো অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।

নগরীর নওদাপাড়াস্থ বনবিভাগের ফরেস্ট থেকে প্রায় দেড়শ অধিক পুরোনো ও দামিদামি গাছ কর্তন করে স্থানটিকে বৃক্ষ শূণ্য করে ফেলা হলেও বিষয়টির প্রতি বিন্দু পরিমাণও ভ্রুক্ষেপ নেই পরিবেশবাদী নামের তকমা লাগানো সংগঠণটির। বিষয়টি নিয়ে নগরীর সচেতন মহলের রয়েছে নানামূখি বিরূপ প্রতিক্রিয়াও। পরিবেশ রক্ষার্থে যে সংগঠণ বিগত সাত বছর ধরে নিজেদের সাংগঠণিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে নতুন নতুন কার্যনিবাহী কমিটি গঠণের মধ্য দিয়ে; তারা কেনো পুরো একটি ফরেস্ট নিধনের বিষয়টি যেনেও চুপ করে বসে আছে। নাকি তারা এই বিষয়ে অবগত নন! যদি সেটাই হয় তবে, নামমাত্র সংগঠণ করে কি লাভ বলেও প্রশ্ন তোলেন নগরীর সচেতন ব্যক্তিরা। ‘নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ এর সভাপতি এনামুল হক বলেন, আগামী ৩ ডিসেম্বর বিএনপি’র কর্মসূচির পর আমরা সরেজমিনে মাঠে নামবো। নগরীতে দেড়শো গাছ কর্তনের বিষয়ে এই সংগঠণটি অবগত নন বলেও তিনি স্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, পরিবেশ ভারসাম্য বিনষ্ট হবার বিষয়গুলো আমাদের কাছে তৎক্ষণাৎ আসেনা।

তথ্য সরবরাহ ও অবগত হবার বিষয়টির প্রতি আমরা একটু পিছিয়ে আছি বলেও তিনি সরাসরি স্বীকার করেন। যেটাই হোক সবুজায়নের এই নগরীকে বৃক্ষ নিধন ও পুকুর ভরাটের মতো ভয়ঙ্কর কর্মকান্ড থেকে রক্ষার নিমিত্তে শুধু পরিবেশবাদী সংগঠণেরই একক কোন দায়ভার নেই, এই দায় ও দায়িত্ব সকল নাগরিকেই থাকা উচিত বলে মন্তব্য অনেকের। কোন অঞ্চলের সামগ্রীক পরিবেশগত দিকটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে গাছ কিংবা উদ্ভিদের উপর। এইসকল উদ্ভিদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বলে কিংবা লিখে শেষ করা যাবেনা। নগরায়ন, বহুতল ভবন ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরির মতো ভৌতিক অবকাঠামো নির্মাণ করার কারনে অপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে পরিবেশ ভারস্যামের বিষয়গুলোকে। কখনো বৃক্ষ নিধন আবার কখনোবা পুকুর জলাশয় ভরাটের মতো কর্মকান্ডের বেড়াজালে পতিত হয়েছে হয়েছে সবুজায়নের এই নগরী। শিক্ষা নগরীকে ঘিরে পরিবেশগত এই ভয়াবহতা কিভাবে বন্ধ করা যায় সেটি নিয়ে শুধু পরিবেশবাদি সংগঠণই নয়; সকলকে এককাতারে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য সচেতন ব্যক্তিদের।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris