এফএনএস : সুপ্ত উত্তাল আগুনে ফুঁসছিল গোটা বাংলা। মুক্তিপাগল বাঙালী শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখে চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায়। সকাল পৌনে ১১টা হবে। ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হলো। শোক আর প্রতিবাদের প্রতীক কালো পতাকা উড়ছে, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত মাজদা গাড়ির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে, আর উইন্ড স্ক্রীনে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা। লাখো বাঙালী হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, গত কয়েক দিনে এ দেশে পাক সেনারা যা ঘটিয়েছে তার প্রতিবাদ এবং আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান না এলে চূড়ান্তভাবে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে লাল সূর্যের বুকে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়বে।
সকাল থেকেই উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খানের বৈঠকের ফল কী হয় তা জানতে। এক হাতে কালো পাইপ, অন্য হাতটি নাড়ছেন জনতার উদ্দেশে। সঙ্কট নিরসনের আন্তরিক আশা নিয়ে তিনি বলেছেন প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠকটি শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আরও আলোচনা হবে। তবে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রধান প্রধান শিরোনামে লেখা হয়- “সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালীর অপ্রতিদ্বন্দ¡ী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেড় শ’ মিনিট কাল স্থায়ী এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন…।” একজন চাইছেন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, অন্যজনের মনে গণহত্যার ছক। একজনের মনে স্বাধীনতার মন্ত্র, অন্যজনের মনে নির্মূল করার বাসনা। একজন কামনা করছেন আর রক্তপাত নয়, আরেকজন দেখতে চান রক্তের হোলি খেলা। এই যেখানে আলোচনার প্রেক্ষাপট, সেখানে বৈঠক কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে! ইতিহাসের দিকে তাকালেই এ সত্যতা পাওয়া যায়।
এদিন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পাশাপাশি সারাদেশে আন্দোলন বাঁধভাঙ্গা রূপ নিয়েছে। রাজপথ মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষজনও দেশের উদ্ভূত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এরই মধ্যে ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা নিয়ে তোলপাড়।
অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিন একাত্তরের এ দিনে বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ এলোÑ এখন থেকে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক কেন্দ্রের শুল্ক, কর, আবগারি কর ও বিক্রয় কর গ্রহণ করবে। কিন্তু এসব কর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে জমা দেয়া হবে না। এভাবেই অসহযোগ আন্দোলন তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় মওলানা ভাসানী ময়মনসিংহের জনসভায় দাবি করেন- “বাংলাদেশের পাওনা বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিন।” চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বুদ্ধিজীবীদের সভায় আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
বসে নেই পাক হানাদাররা। সাতক্ষীরার মিছিলে গুলি চালিয়ে মানুষ মারা হলো, দেশের মানুষকে অনাহারে মারার চক্রান্ত করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা চার জাহাজ বোঝাই গম চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস না করে করাচী পাঠিয়ে দেয়া হয়। এগুলো এসেছিল ত্রাণ হিসাবে।