মঙ্গলবার

২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একুশ আমাদের

Paris
Update : শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

এফএনএস: কবি রফিক আজাদ ‘পঞ্চানন কর্মকার’ কবিতায় লিখেছেন-‘যুগ-পরম্পরাক্রমে প্রাগৈতিহাসিক উৎস থেকে/উৎসারিত হতে থাকা নিরন্তর মনুষ্য জীবন/মুদ্রিত গ্রন্থের মূল্যে ইতিহাসঃ মানব-সভ্যতা।’ বাংলাভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে একাদশ শতাব্দীতে সেন রাজাদের রাজত্বকালে। তখন বাংলাভাষা এক ভয়ানক সঙ্কট ও অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ সময় বাংলার বৌদ্ধশাসন উৎখাত করে সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা বাংলাভাষা চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করেন।

বাংলাভাষার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত ও ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছিলেন, ‘ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পন্ডিত মন্ডিলী ‘দুর দুর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাক্ষèণরা যে রূপ দুরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধীজনের অপাঙ্কতেয় ছিল, তেমনি ঘৃণার, অনাদরের ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।’ ভাষা আন্দোলন গবেষক মোহাম্মদ আমীন লিখেছেন, ‘দেড় হাজার বছর আগে প্রকৃত ভাষা থেকে বাংলাভাষা জন্ম নেয়ার পর বাংলার কবি এবং গায়েনরা বাংলাভাষায় কবিতা, গান গেয়ে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ কথাবার্তার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে প্রসারের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে।

শিশু ভাষাটি যখন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছিল তখনই সেন রাজবংশ বাংলাভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমআর মাহবুব ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে এমন তথ্য উল্লেখ করেন। তাঁর ওই গ্রন্থে বলা হয়েছে, ষোল ও সতের শতকে বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ও বেসরকারীভাবে ব্যবহৃত হত। সেই থেকে বাংলাভাষা প্রথম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ভাষাবিজ্ঞানী ড. এসএম লুৎফর রহমান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা সরকারী কাজে তার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তার নির্দিষ্ট তারিখ জানান না দেয়া গেলেও, এ তরফে সব নমুনা-নিশানা করা গিয়েছে।’ তা থেকে দেখা যায়- সতের শতকের পয়লা দশক থেকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি ও সরকারী ব্যবহার ঘটে চলেছে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত দেন, একজন ব্রিটিশ লেখক ‘ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হলহেড। বাংলার ১৭৭৮ সালে তার বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটিতে। হলহেডের বাংলা হরফে মুদ্রিত এটিই প্রথম বাংলা গ্রন্থ। তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম্ভাবনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী এবং জনমত প্রকাশ করতে থাকে। তন্মধ্যে ১৯৪৮ সালে ২২ জুন দৈনিক ইত্তিহাদে প্রকাশিত আবদুল হকের কলাম ছিল প্রথম। ২৯ জুলাই মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নিবন্ধটি ছিল বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এসব নিবন্ধের অধিকাংশের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দেয়া প্রসঙ্গে।

১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ এর একটি সভায় একই দাবি উত্থাপিত হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে, নতুন সংগঠন তমুদ্দন মজলিস, তারা হলেনÑ অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, আবুল মনসুর আহমদ এবং কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁরা এ বইয়ে বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করেন। তাঁরা ফজলুল হক মুসলিম হলে ১২ নভেম্বর একটি সভা করে। এ সভার পূর্বে পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজ ৫ নভেম্বর এ সংক্রান্ত একটি সভা করে। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ডিসেম্বর মাসে যখন ৫ ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

প্রস্তাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে ব্যবহার এবং প্রাথমিক স্তরের আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এসে জড়ো হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও দাফতরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়। ভাষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রথম সভা ছিল সেটি। ডিসেম্বরের শেষেরদিকে ছাত্ররা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris