এফএনএস : আনিসুজ্জামান ‘তারা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘প্রতি ফাল্গুনে তারা ফিরে আসে/পত্র পুষ্পের মিতালিতে যেখানে বর্ণের সমারোহ/সেখানে নয়। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগে উচ্ছ্বলিত/প্রাণ-প্রবাহের মোহনা যেখানে, সেখানে/তারা ফিরে ফিরে আসে।’ শিল্প সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে লেখা হয়নি। সব ক্ষেত্রে বর্বর পাকিস্তানীদের নানা রকম চক্রান্ত ছিল। তারা পূর্ব বাংলা থেকে বাংলাভাষাকে বিলীন করে জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালায়। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র বাংলার মানুষ সফল হতে দেয়নি।
পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর সব চক্রান্ত রুখে দিয়ে সেদিন বাঙালীরা নিজের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীর অনেক অর্জন সূচীত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নতুন রাষ্ট্রের দুই খন্ডে দুই ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষদের এক বন্ধনে বেঁধে রাখার কৃত্রিম প্রচেষ্টা শুরু হয়। পাকিস্তানের মুসলমানদের ঐক্যের সূত্র হিসেবে একটি ভাষা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার সিদ্ধান্ত নিলে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা তা প্রত্যাখ্যান করে।
শিক্ষিত সমাজে প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়। ছাত্ররা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার হয় এবং আন্দোলনে নেমে পড়েন। প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ভাষা-আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপের দিন পুলিশ ছাত্রজনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেদিন শহীদ হন রফিক, শফিউল, বরকত, জব্বারসহ নাম জানা অজানা আরও অনেকে। পুলিশের গুলির প্রতিবাদে বাংলার মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। শুরু হয় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল সমাবেশ। ১৯৫২ সালের সেই দিনের স্মৃতি স্মরণীয় করে রেখেছে বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি মাতৃভাষা আন্দোলনের নানা বিষয় উপস্থাপন করেছে।
মাতৃভাষা হচ্ছে সেই ভাষা, চেষ্টা করে যা শিখতে হয় না। শিশু জন্ম নেয়ার পর থেকেই এই ভাষাতেই তার মনের ভাব প্রকাশ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা মাতৃভাষাকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিঃশেষে প্রাণদান এবং এ আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতিসত্তার উপলব্ধি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের তাজারক্তে রাজপথ যখন রঞ্জিত হয় তখন এ দেশের মানুষ মাতৃভাষাকে নতুনভাবে অর্জন করে। এ অর্জন দিয়েছিল অদম্য সাহস, যুগিয়েছিল সীমাহীন প্রেরণা।
২১ ফেব্রুয়ারি একুশ নামে পরিচিত হলো। একুশ পূর্ব-বাংলার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। একুশ থেকে সৃষ্টি হয় ২১ দফা। এই ২১ দফা একটি ঐতিহাসিক দলিল। ২১ দফার চারটি দফা ছিল ভাষা ও একুশ সংক্রান্ত। ২১ দফা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে জনমনে এতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে।