শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভ্যাট কোষাগারে জমা দিচ্ছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা

Paris
Update : শুক্রবার, ১ জানুয়ারি, ২০২১

এফএনএস : অসাধু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ভ্যাটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেরাই হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করছে। এমন প্রতারণার কারণে সরকার শত শত কোটি টাকার ভ্যাট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এনবিআরের ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮শ’ রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। ওসব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৬৭ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে। কিন্তু সরকারের কোষাগারে তা জমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটির ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকারও বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভ্যাট ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই দুই ধরনের হিসাব রাখে। অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দিতে আয়-ব্যয়, বিক্রি ও মুনাফার মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করে রিটার্ন জমা দেয়। এনবিআর কর্মকর্তারা অভিযানে গেলে তারা ওসব মিথ্যা হিসাব দেখিয়ে থাকে। আবার একই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধার জন্য গোপনে প্রকৃত আয়-ব্যয়, বিক্রি মুনাফা ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্য সংরক্ষণ করে। প্রকৃত হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি ও ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যের মিল থাকে।

সূত্র জানায়, ভ্যাট গোয়েন্দাদের অভিযানে দেখা যায়, ডিবিএল সিরামিকস লিমিটেড ভ্যাট আদায় করেও তা পরিশোধ করেনি। অভিযানে ডিবিএলের কারখানার হিসাবের সব রেজিস্টার খাতাপত্রসহ অন্য কাগজপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভ্যাট ফাঁকির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর ভ্যাট গোয়েন্দারা প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্যের মজুদের হিসাব নিতে থাকে। ওই সময় দেখা যায়, ডিবিএল সিরামিকস ৬ মাসেই ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৭ বর্গফুট উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেছে এবং ৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। একইভাবে ভ্যাট গোয়েন্দারা হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের আয়-ব্যয়ের তদন্ত করে ৪ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ৯৮ টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে।

প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাটের ওই অর্থ আদায় করেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। ফলে গত ১৬ নভেম্বর ওই বিষয়ে মামলা করা হয়েছে। ফরিদপুরের পান্না ব্যাটারি লিমিটেডে ভ্যাট গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত বিক্রির তথ্য গোপন করে ৬২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে। সেজন্য গত ১৪ অক্টোবর ভ্যাট গোয়েন্দারা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

সূত্র আরো জানায়, দেশের অনেক চালু শপিং মল সারা বছর রমরমা বেচাকেনা করলেও ভ্যাট নিবন্ধনই নিচ্ছে না। অথচ ওসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্যের সঙ্গে হিসাব কষে ঠিকই ভ্যাট আদায় করছে। গোয়েন্দারা চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেট, রাজধানীর মৌচাক মার্কেট, পিংক সিটি, নিউ মার্কেট, গাউছিয়ায় অভিযান চালিয়ে এমন শতাধিক দোকানের খোঁজ পেয়েছে। সব দোকানের এখন পর্যন্ত ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকারও বেশি।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, লোকবলের অভাবে সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না যেমন সত্য। তেমনি আবার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অভিযানে যাওয়া এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েও ভ্যাট ফাঁকির তথ্য গোপন করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অসাধু এনবিআর কর্মকর্তা উভয় ক্ষেত্রেই নজরদারি বাড়াতে হবে। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ বিক্রয়কেন্দ্র ভ্যাট প্রদানে সক্ষম। অথচ এনবিআরে ভ্যাট নিবন্ধিত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র সাড়ে ৭ লাখ। তার মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে। আর মোট ভ্যাট আদায়ের ৫৬ শতাংশই পরিশোধ করে ১৩০ থেকে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাতিল করে অনলাইনে গেছে। পাশাপাশি ভ্যাট প্রদানে সক্ষম সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়।

অন্যদিকে এনবিআরের তথ্যানুযায়ী তাদের সর্বশেষ হিসাবে ২ লাখের বেশি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। তার মধ্যে ৭০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছে। আর এনবিআর সংশ্লিষ্টরা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে ভবিষ্যতে ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে আনা সম্ভব বলে আশাবাদী। এ প্রসঙ্গে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, এনবিআরে লোকবলের অভাব রয়েছে। সেজন্য সব প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে ভ্যাটের তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয় না। তবে ভ্যাট গোয়েন্দারা ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে আগের চেয়ে অভিযান বাড়িয়েছে। সারা দেশেই এই অভিযান চলছে।

একই প্রসঙ্গে এনবিআর সদস্য (মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা) জাকিয়া সুলতানা জানান, বড়মাপের অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। ওসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গেই ভ্যাট আদায় করে। তারপর তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ইসিআর মেশিন বা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো বিক্রির তথ্য সেব মেশিনে না দিলে তার প্রমাণ থাকে না। মূলত ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির তথ্য মেশিনে না দিয়ে তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। তবে ক্রেতা যদি বিক্রেতাকে রশিদ দিতে বাধ্য করে তবে মেশিনে প্রমাণ থাকবে এবং এনবিআরের তদন্তে তা ধরা পড়বে। জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেও সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়া আমানতকে খেয়ানত করা হয়। ওই ফাঁকিবাজদের জন্য সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris