সুমন আলী, নওগাঁ : শীত মৌসুমে খাবারে মুখরোচক স্বাদ আনতে মাছ-সবজিতে কুমড়া বড়ির প্রচলন দীর্ঘ দিনের। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয় খাবার এই কুমড়ার বড়ি। শীতের পিঠাপুলির মতো কুমড়া বড়িরও খুব কদর থাকে শীত মৌসুমে। সেই মুখরোচক সুস্বাদু কুমড়া বড়ি যত্নসহকারে তৈরি করছেন নওগাঁর গ্রামীণ নারীরা। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এই বড়ি তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করেন অনেক নারী।
জানা যায়, নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লা, রানীনগর, আত্রাই, মান্দা, মহাদেবপুর ও বদলগাছী উপজেলার গ্রামীণ নারীরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সারাবছরই কমবেশি কুমড়া বড়ি তৈরি হয়। তবে শীত মৌসুমে এটার চাহিদা বেশি থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে হাটে-বাজারে নানা ধরনের শীতের সবজি ওঠে। এই সময় গ্রামাঞ্চলের খাল-বিল ও নদীতে পানি কম থাকায় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। শীতকালীন এসব সবজি আর খালবিলে পাওয়া দেশীয় প্রজাতির মাছ রান্নাতে ব্যবহার হয় এই কুমড়ো বড়ি। এতে খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কিন্তু কাজের ব্যবস্থার কারণে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও সুস্বাদু এই কুমড়া বড়ি তৈরি করতে পারে না। স্বাদে ও মান ভালো হওয়ায় সেই চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় যায় গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি এই কুমড়া বড়ি। এমনকি যাচ্চে ভারত ও মালোশিযায়।
নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লায় একটি চালকলে গিয়ে কারিগরদের সঙ্গে কথা হলে নারী কারিগররা জানান, দেশীয় উপাদানে তৈরি করা হয় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ কুমড়ো বড়ি। প্রথমে বাজার থেকে মাসকালাইয়ের ডাল কিনে এনে যাতাতে ভাঙাতে হয়। ভাঙানোর পর ২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে মাসকালাইয়ের গাঁ নরম হলে চটের বস্তায় ঘষে খোসা তুলে পানিতে ভালোভাবে ধুতে হয়। এক সময় শিলপাটায় বেটে বড়ি তৈরি করা হলেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেশিনের মাধ্যমে কুমড়া বড়ি তৈরির ডাল ফিনিশিং করা হয়। তারপর কালাই জিরা, মহুরি, কুমড়ো দিয়ে ফ্যাট তুলে নিয়ে ছোট ছোট করে বসানো হয় বড়ি। দুই-তিন দিন ভালো করে রোদে শুকালেই খাওয়ার উপযোগী হয় সুস্বাদু এই কুমড়া বড়ি। তবে এ কাজে নারীদের হাতের ছোঁয়াই বেশি। ঝর্ণা রানী মহন্ত নামে এক নারী কারিগর বলেন, বিয়ে হয়ে আসার পর আমার শাশুড়ির কাছ থেকে এই কুমড়া বড়ি তৈরি শিখেছি। আমার কাছ থেকে আমার ছেলের বউ শিখেছে। মাসকলাইয়ের ডাল আর চাল কুমড়ার মিশ্রণে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় এই বড়ি। যে মানুষ এই কুমড়ো বড়ি খায়নি, সে কখনও এর স্বাদ বুঝবে না। বিশেষ করে কুমরা বড়ি দিয়ে লাউ, শোল মাছ রান্না করলে সেই স্বাদ। এছাড়াও যেকোনো মাছ ঝোলে বা সবজির সাথে এই বড়ি রান্না করে খাওয়া যায়। আবার অনেকে এখন গোস্ত দিয়ে রান্না করে খায়। এই কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। কারণে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততা বাড়ে আমাদের। তিনি আরও বলেন, এখানকার বড়ি খেতে ভালো হওয়ায় সারাদেশেই চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাক, চট্রগ্রাম, খুলনা যায়। এছাড়াও ভারত ও মালোশিয়ায় যায়।
কাঞ্চন রাণী সূত্রধর নামে আরেক কারিগর বলেন, কমবেশি সব সময়ই কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে। রোদে শুকানোর পর খাওয়ার উপযোগী হলে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা হয়। তবে বেশি বাড়িতেই এসেই পাইকাররা নিয়ে যায় বড়ি। মান ভেদে প্রতি কেজি বড়ি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। অনেকেই সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এই বড়ি তৈরি করে যে টাকা পায় সংসারের কাজে লাগায়।
স্বপ্না রানী নামে এক কারিগর বলেন, আমরা যারা এই কাজ করি বেশিরভাগ মানুষ গরিব। অল্প পুঁজির কারণে অনেক সময় সমস্যাই পড়তে হয়। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। খুব একটা লাভ হয় না। সরকার থেকে আমাদের সাহায্য করলে আরও ভালোভাবে বড়ি তৈরি করে বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা যেত। নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীর উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, এই কুমড়া বড়ি গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যের অংশ। এই কাজের সঙ্গে বেশির ভাগ নারীরা জড়িত। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বড়ি তৈরির কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ স্বল্প সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা হবে। বাংলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা সবসময় পাশে আছি।