সনি আজাদ, চারঘাট : ৮০ বছরের বৃদ্ধা মাজেদা বেওয়া। বৃহস্পতিবার চারঘাট উপজেলার ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসেছিলেন পেটের সমস্যাজনিত কারণে। ক্লিনিকের ভেতরে প্রবেশ না করতেই টয়লেটের চাপ আসে তাঁর। কিন্তু ক্লিনিকে নতুন শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী না থাকায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিজ বাড়িতে ফেরত নিয়ে যান স্বজনরা। এতে সেবা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় মাজেদা বেগমকে। সেবা গ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার কারণে রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো থেকে এভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। সরকারি ক্লিনিকে সেবা নিতে না গিয়ে গ্রামীণ ওষুধের দোকানে চিকিৎসা নিয়ে আরে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। অথচ এই দুই উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে কোটি টাকা খরচ করে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজে ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে শৌচাগারগুলো ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় সেগুলো নির্মাণের পরে একদিনও ব্যবহার হয়নি। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে কমিউনিটি ক্লিনিকমুখী করার সরকারি উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা দুই উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে দুই উপজেলার (রাজশাহী-৬ আসন) ৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিকে শৌচাগার (ওয়াশব্লক) নির্মাণ করা হয়। এতে নির্মাণ ব্যায় ধরা হয় ১ কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। প্রতিটি শৌচাগারে ব্যায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি শৌচাগারে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক দু’টি টয়লেট, ওয়াশ রুম ও ১টি হাত ধৌত বেশিন স্থাপন করা হয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ২০২২ সালে শৌচাগার গুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২১ সালে (চারঘাট-বাঘা) সংসদীয় আসনে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের বরাদ্দের পুরো টাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের গুলো শৌচাগার নির্মাণে ব্যায় করা হয়। মূলত টাকাগুলো খরচ করার জন্য তড়িঘড়ি করে লোক দেখানো এ প্রকল্প
নেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের গুলো পরিদর্শন কিংবা সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই না করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শৌচাগারগুলো নির্মাণের সময়ও ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ববানদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। এতে সবগুলো শৌচাগারই অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
সরেজমিন চারঘাট ও বাঘা উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায়, সবগুলো কমিউনিটি ক্লিনিকের শৌচাগারে তালা ঝুলছে, অধিকাংশ তালায় মরিচা ধরেছে। নির্মাণের দুই বছর অতিবাহিত হলেও কোনো ক্লিনিক কতৃপক্ষ এখনো তা বুঝে পাননি। যারা বুঝে পেয়ে পেয়েছেন তারাও তা ব্যবহার করতে পারছেন না। কোনটাতে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, আবার কোনোটাতে পানির ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রথম এক সপ্তাহে নষ্ট হয়ে গেছে। কোনটাতে পানি থাকলেও পানির লাইন ও শৌচাগারের প্যান ত্রুটিপূর্ণ ভাবে স্থাপন করায় তা ব্যবহার উপযোগী নেই। পূর্বে স্থাপনকৃত অগভীর নলকূপের পানির
টাংকি থেকে শৌচাগারগুলো পানির লাইন দেওয়া হয়েছে। এভাবে সবগুলো শৌচাগারই ব্যবহার করার আগেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
চারঘাটের হাবিবপুর গ্রামের কৃষক মোত্তাকিন আলী বলেন, গ্রামের নারীরা কেউ কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে চাইনা। মাঝে নানা কারণে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলে টয়লেটে যেতে হয় তখন বাড়িতে দৌড় দিতে হয়। এজন্য কোনো শারিরিক সমস্যা হলে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে দিই। এতে টাকা দিয়ে যেমন ওষুধ কিনতে হয়, তেমনি অসুখ ভাল না হওয়ায় পরে সদর হাসপাতালে যেতে হয়। ক্লিনিকের টয়লেট কয়েক বছর ধরে শো হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
চারঘাট উপজেলার ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আকতার বানু বলেন, দুই-আড়াই বছরআগে আমাদের ক্লিনিকের শৌচাগার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তারপর থেকে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে, চাবিটাও দিয়ে যায়নি। এজন্য একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। শৌচাগেরর প্যান, পানির লাইন, টাইলস সবই নিম্নমানের স্থাপন করা হয়েছে। রোগীরা এসে কষ্ট পায় কিন্তু নতুন শৌচাগার
থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারেনা। বাঘা উপজেলার আড়পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার ফিরোজা খাতুন বলেন, শৌচাগার নির্মাণ করে দিয়েছে, কিন্তু পানির ব্যবস্থা নেই। এজন্য নির্মাণের পর থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ক্লিনিকের ভেতরে একটা টয়লেট আছে সেটা আমরা ব্যবহার করি, কিন্তু রোগীদের টয়লেটে যাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য মাঝে মাঝেই রোগীদের নিয়ে খুবে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চারঘাট উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি আঞ্জুমনোয়ারা ময়না বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যারা সেবা গ্রহণ করেন তাদের অধিকাংশই নারী। মাতৃসেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা ও ওষুধ গ্রহণ করেন তারা। অথচ এখানে শৌচাগার নির্মাণের নামে প্রকল্প নিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। নির্মাণের সময় আমরা মতামত দিলেও তা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সবগুলোর কাজ করা যেত। নিম্ন মানের নির্মাণকাজে এখন সবগুলো অকেজো। লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোটি টাকা পানিতে ফেলা হয়েছে।
চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে এখন ৩০ রকমের ওষুধ সরবরাহ থাকে। একবারে গ্রামীণ রোগীরা যারা সব সময় উপজেলা সদরে আসতে পারেন না তারা সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ গ্রহণ করেন। সেবাগ্রহীতা রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য শৌচাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শৌচাগার নির্মাণ হলেও সেগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। আগামী সভায় বিষয়টি নিয়ে সিএইচসিপিদের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ ফরহাদ লতিফ ও বাঘা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুল ইসলাম বলেন, কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে কোন ক্লিনিকে কি সমস্যার কারণে শৌচাগারগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছেনা এ বিষয়ে ক্লিনিকগুলোর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ভাবে জানালে সেগুলো মেরামত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।