সনি আজাদ, চারঘাট : রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নন্দনগাছী বাজার রেলগেটের গেট কিপার এনামুল হক। তার দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায়। সেখানে অসুস্থ বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে যে বেতন পান তা পাঠালে কোনোভাবে বিছানাগত বাবার ওষুধসহ পরিবারের সদস্যদের খাবার জোটে। কিন্তু ছয় মাস ধরে বেতন না পেয়ে টাকা পাঠাতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
শুধুমাত্র এনামুল হক না, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ৭৫৩ জন গেট কিপার টানা ৬ মাস বেতন পাচ্ছেন না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। প্রকল্পের ফান্ডে অর্থ না থাকায় বেতন প্রদানে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে কবে নাগাদ বেতন হতে পারে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারনা দিতে পারেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল সূত্রে জানা যায়, “বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন” নামে প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ১ জুলাই একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে ৭৫৩ জন গেট কিপার নিয়োগ দেওয়া হয়। এই গেট কিপারদের রাজস্বখাতে স্থানান্তরে পশ্চিমাঞ্চলের প্রস্তাবনা ২০১৯ সালের আগস্টে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়। অর্থ বিভাগের ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৭০৭ স্মারকের আলোকে ১৯৯৭ সালের জুলাই এবং তৎপরবর্তীতে শুরু হওয়া প্রকল্পের পদ রাজস্বখাতে স্থানান্তরের সুযোগ নেই বলে জানানো হয়। এতে গত ৯ বছরেও নিয়োগপ্রাপ্ত গেট কিপাররা রাজস্ব খাতে যুক্ত হতে পারেননি। প্রকল্পের ফান্ড থেকেই তাদের প্রতি মাসে বেতন হয়। কিন্তু ফান্ডে বর্তমানে কোনো টাকা না থাকায় গত ছয় মাস যাবত তারা কোনো বেতন পাচ্ছেন না।
জানা যায়, এই প্রকল্পের অধীনে ৮৫১ জন গেট কিপার নিয়োগ(বর্তমানে কর্মরত আছে ৭৫৩ জন), গুমটি ঘর নির্মাণ/পুননির্মাণ, রোড সারফেস মেরামত, গেটের বেরিয়ার স্থাপন, চেক রেল, বেয়ারিং প্লেট, চেকব্লক, চেকবোল্ট, উডেন স্লিপার সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় সিগন্যালিং ওয়ার্ক সম্পাদন এবং লোডিং আনলোডিংয়ে ৩২২টি গেট তৈরির কথা রয়েছে। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ শেষ হলেও গেট কিপারদের বেতন রাজস্ব তে যুক্ত হওয়া নিয়ে তৈরি জটিলতায় প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। দ্বিতীয় দফা সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে হয় ১১৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তৃতীয় দফা সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকার প্রস্তাবনা দিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।
সরেজমিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন এলাকার গেট কিপারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পে গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়নের কথা বললেও বাস্তবে গেটগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। গেট কিপাররা বেতন তো পাচ্ছেন না, উল্টো নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ট্রেনের অবস্থান জানতে হয়।
গেট কিপাররা জানান, রেলেগেটের পাশে তাদের বিশ্রাম ঘরে বৈদ্যুতিক লাইন ও টয়লেটের সমস্যা রয়েছে। স্টেশন থেকে ট্রেন আসা-যাওয়ার সংকেত দেওয়া হয় না। এক গেট কিপার অন্য কিপারকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ী গেট ফেলানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এজন্য গেট কিপারদের মোবাইল বিলও দেওয়া হয় না। বেতন বন্ধ থাকায় নিজে খেতে না পেলেও মোবাইলে টাকা ঢুকিয়ে গেট পাহারা দিতে হয়।
বাঘা উপজেলার আড়ানী ব্রীজ রেলগেটের গেট কিপার তাহমিনা খাতুন বলেন, আমার দেশের বাসা কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। মা ও ছেলেকে নিয়ে এখানে ভাড়া বাসায় থাকি। ছয় মাস বেতন বন্ধ থাকায় পরিবারের খরচ মেটাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্রতি মাসেই বেতন হবে শুনি কিন্তু হয়না। চারঘাট উপজেলার বাসুদেবপুর রেলগেটের গেট কিপার লায়েব উদ্দিন বলেন, পেট ক্ষুধা রেখে দিন-রাত গেট পাহার দিচ্ছি। কিন্তু মাস শেষে বেতন পাচ্ছিনা। ধার-দেনা করে পরিবারের খরচ জোগাতে হচ্ছে। আমরা এত পরিশ্রম করি, কিন্তু আমাদের প্রতি কারো দয়া হয় না।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একটি সূত্র বলছে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রকল্পের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। এই প্রকল্পের মূল ব্যয় ৪৭ কোটি টাকা থাকলেও বর্তমানে ১৩০ কোটির প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। শুধু গেট কিপারদের জন্য এ প্রকল্পে ব্যয় ও সময় বাড়ছে। তাতে একনেকে এ প্রস্তাব পাশ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় গেট কিপাররা কবে নাগাদ বেতন পাবেন সেটা বলা যাচ্ছেনা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক বীরবল মন্ডল বলেন, প্রকল্পের ফান্ডে কোনো টাকা নেই। এজন্য ৭৫৩ গেট কিপারের বেতন হয়নি। একনেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে তাদের বেতন দেওয়া সম্ভব, নয়তো সম্ভব না। তাদের চাকরি রাজস্বতে নেওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।