ই-বর্জ্যরে ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী দেশ। ই-বর্জ্যরে কারণে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুবিক সমস্যা, শ্রবণ সমস্যা, দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি, শিশুমৃত্যু, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা হয়। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, ভূমিদূষণসহ বন্যপ্রাণীর জীবনের হুমকিও তৈরি করছে ই-বর্জ্য। এ অবস্থায় সরকার ই-বর্জ্য বিধিমালার আওতায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় একটি ই-বর্জ্য গাইডলাইন তৈরি করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে আইটি, মিডিয়া ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু ওসব পণ্য ব্যবহার থেকে ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পরিবেশে ছড়াচ্ছে। যা তা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। দেশে প্রতি বছর ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু মোবাইল সেট থেকেই তৈরি হচ্ছে সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। আর নষ্ট টেলিভিশন থেকে তৈরি হচ্ছে ১ দশমিক ৭ লাখ টনের মতো ই-বর্জ্য। প্রতি বছরই ই বর্জ্যরে পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ একটি মোবাইল ফোন রিসাইকেল করা গেলে তা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু দেশে রিসাইকেল কারখানা তেমন না থাকায় উদ্যোক্তারা সেগুলো সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সাধারণত যেসব পণ্য থেকে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- টিভি ও কম্পিউটার মনিটর, টিভি ও কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, অডিও ও ভিডিও প্লেয়ার, সিএফএল বাল্ব, ভিডিও ক্যামেরা, টেলিফোন ও মোবাইল সেট, ফ্যাক্স ও ফটোকপি মেশিন ইত্যাদি। সূত্র জানায়, দেশে এখনো ই-বর্জ্য নিয়েও তেমন সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। মোবাইল ফোনে কী ধরনের ভারী ধাতু আছে বেশির ভাগ ব্যবহারকারী ও মেরামতকারীরা তা জানেন না। ৭৩ শতাংশ মোবাইল মেরামতকারী পুরনো ও নষ্ট মোবাইল সেট স্টোর রুমে ফেলে রাখেন। আর ৪০ শতাংশ মোবাইল ব্যবহারকারীরা বাসা থেকে শুরু করে যত্রতত্র নষ্ট মোবাইল ফোন ফেলে রাখেন। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য স্তূপ করা হয় ইসলামপুর, কামরাঙ্গীচর, জিনজিরা, মিরপুর ১১ ও ১২ নম্বর এবং মোহাম্মদপুরে। বর্তমানে দেশের ৫০ হাজারের বেশি শিশু ই-বর্জ্য সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার জড়িত। ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ১৫ শতাংশের বেশি শিশু মারা যায়। আর ৮৩ শতাংশের বেশি শিশু বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সূত্র আরো জানায়, ই-বর্জ্যরে মধ্যে সিসা-পারদের মতো অস্বাস্থ্যকর বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ায় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে মানুষের গর্ভাবস্থা, শৈশব ও কৈশোরকালে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশকে ব্যাহত করে। এতে ফুসফুসের গঠনগত বিকাশ এবং কার্যকারিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে মাত্র হাতে গোনা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান আছে। যদিও তাদের কর্মপদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন সংস্থার দাবির মুখে দেশে ২০২১ সালে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়। কিন্তু দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সেভাবে চোখে পড়ে না এবং ওই বিধিমালা প্রয়োগের বিষয়টিও বেশ শিথিল। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এ যন্ত্রগুলোর লাইফটাইম শেষ হলে রিসাইকেল না করা গেলে পরিবেশের ওপর হুমকি থাকে। কারণ ওসব বর্জ্যে বেশ কিছু ক্ষতিকর পদার্থ থাকে। যেগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। আবার ই-বর্জ্য যদি রিসাইকেল করা হয় তাহলে এ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। ই-বর্জ্য বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। আর যে নীতিমালা এ বিষয়ে করা হয়েছে তা প্রায় ১০ বছর আগের। কিন্তু এত বছরেও কোনোভাবে এটি কার্যকর করা যায়নি। যেহেতু প্রচুর ইলেকট্রনিক ডিভাইস আসছে এজন্য এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। দেশে আন্তর্জাতিকমানের রিসাইকেল প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশের দিকে নজর দিয়ে এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ খাতের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে যারা ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে এবং ডিজিটাল পণ্য ব্যবহার করার সবার বিষয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। অন্যদিকে সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, সরকার ই-বর্জ্য বিধিমালা ২০২১ বাস্তবায়ন করবে। যা ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য কমানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) রাজিনারা বেগম জানান, ই-বর্জ্য নিয়ে একটি প্রকল্প চলমান আছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ই-বর্জ্য বিধিমালার আওতায় একটি ই-বর্জ্য গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে। বেশ কিছু রিসাইকেল প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। ই-বর্জ্য রপ্তানি হয়। মানুষের মধ্যে ই-বর্জ্য নিয়ে সচেতনতা কম হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বর্জ্য মানুষ বেশি সংগ্রহ করে। বিধিমালায় ই-বর্জ্যরে জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে তারা যেন এটি বাস্তবায়ন করে। ই-বর্জ্য নিয়ে যে গাইডলাইন হচ্ছে সেখানেও বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।-এফএনএস