মোবারক হোসেন শিশির : একটাকা দুই মেয়াদে এমপি গিরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্প দেওয়ার নামে কমিশন বানিজ্য, সরকারী জলমহাল সাব-লীজ দেওয়া সহ বিভিন্ন দূর্নীতি অনিয়ম করে পাঁচ’শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। গত ১০ বছরে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০০ নিয়োগ হয়। এর মধ্যে পুঠিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে ২১৭ জন, কলেজের প্রভাষক পদে ১৮৭ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম পিয়ন পদে ৩১ জনের নিয়োগ হয়েছে। দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে ২০৮ জনের।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মেয়াদের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। এছাড়াও তিনি রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই আসনে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ১০ বছর এমপি ছিলেন। এক মেয়াদ পর ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। ১০ বছর এমপি গিরি করে সরকারি পুকুর ইজারা, কৃষি জমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে পুকুর খনন, বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন আদায়তো ছিলই। ফলে তার নির্বাচনি এলাকায় উন্নয়ন না হলেও উন্নতি হয়েছে তার পরিবারের সব সদস্যের। হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি।
পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ গ্রামে মাটির বাড়িতে তার বসবাস ছিল। বর্তমানে সেই বাড়ির স্থলে পাশাপাশি তিন ভাইয়ের জন্য তিনটি দোতালা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তার মেয়েকে যুক্তরাজ্যে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন। সেখানে তিনি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি হওয়ার আগে আব্দুল ওয়াদুদ দারা এবং স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকার। এর মধ্যে দারার ৭০ লাখ ৩৫ হাজার এবং স্ত্রীর ২২ লাখ ১০ হাজার টাকার। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে সেটি বেড়ে দাড়িয়েছে ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। এর মধ্যে দারার ৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। তার স্ত্রীর ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে তাঁর নিজের নগদ ২ কোটি ২১ লাখ এবং স্ত্রীর ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা আছে নিজের ২ লাখ ৯১ হাজার, স্ত্রীর ৩১ লাখ ৫৫ হাজার এবং নির্ভরশীলদের ৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এছাড়াও ২০০৮ সালে একটি পোষক কারখানার দারার শেয়ার ছিল ১৪ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নিজের নামে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ও স্ত্রীর ২ কোটি ২০ লাখ টাকার।
দারা এমপি থাকাকালীন তার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে যারা গিয়েছেন তাদের একের পর এক হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আর যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তারা সবাই তার বাড়ির আশপাশের লোকজন। নিহতরা হলেন, আবু দাউদ ও তার ছেলে নুহু। তার চাচাতো ভাই রয়েল। চাল ব্যবসায়ী আবুল ও তার স্ত্রী।
এ আসনে ১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রথমে এ আসনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ করে দেওয়ার নামে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তার ১০ বছরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ১০ জন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিটি চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দারার চাচা বিড়ালদহ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলীউজ্জামান মুন্টু ছিলেন শিক্ষা-বাণিজ্যের প্রধান। দুই উপজেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নেওয়ার জন্য দারা এমপির বাড়িতে টাকার চুক্তি করতে আসতেন। নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছে চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতেন মুন্টু। তখন মুন্টুর উপাধি ছিল শিক্ষামন্ত্রীর নাম। দারা যতদিন এমপি ছিলেন ততদিন তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষকদের উপস্থিত থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। মুন্টু বাদে আরও কয়েকজন শিক্ষা বাণিজ্যের চুক্তি করতেন। এরা হলেন, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং সাবেক মেয়র রবিউল ইসলাম রবি, ধোপাপাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান মুন্টু। আর তার চাচাতো ভাই শরীফ কাজী নিয়ন্ত্রণ করতেন দুই উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ বিষয়ের বাণিজ্য। কোনো এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দিলে তাদের আয় হবে- তা দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার। এছাড়াও দারার আরেক চাচাতো ভাই রিপন টানা ১০ বছর উপজেলা পর্যায়ের সব টেন্ডার নিয়ে নিজে কাজ করতেন।
পুঠিয়া-দুর্গাপুর নির্বাচনি এলাকায় সরকারি কয়েকশ খাস পুকুর রয়েছে। প্রতিবছর পুকুরগুলো পানির দামে ইজারা দিয়ে কোটি কোটি আয় করেছেন। দুই উপজেলার কাবিখা কাবিটারসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের প্রকল্পের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের মাধ্যমে তিনি নিতেন। সমেন ঘোষ নামে একজনকে মাস্টার রোলে ওই অফিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। সমেন প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কমিশনের টাকা উঠিয়ে দারাকে দিতেন। সমেনও বর্তমানে কোটিপতি। দারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নাটোর জেলায় বিদ্যুতের কুটল্যান্ড প্যানেলসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় কমিটির সভাপতি হয়ে ছিলেন। তার সময়ে ব্রাজিল থেকে কয়েক হাজার টন পচা গম আমদানি করা হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তার বিরুদ্ধে পুঠিয়া ও দুর্গাপুরে হত্যাসহ চারটি মামলা হয়েছে।