বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে জনতার যুগপৎ আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই কেটেছে। পাশাপাশি ছিল নানা ধরনের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, যা এখনো চলমান রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী বড় ব্যবসায়ীদের অনেকে আড়ালে রয়েছেন। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তে হানা দেয় ভয়াবহ বন্যা। ফলে দেশের ব্যবসাক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারেনি। এদিকে দেশীয় বাণিজ্যে প্রভাবশালী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে তৈরি হয়েছে নানান ধরনের সংকট। অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহে। এক মাসের বেশি সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যায় ক্রেতা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাতুনগঞ্জের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপ এস আলম কোণঠাসা হয়ে পড়ায় সংকট আরও ঘণীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা সত্ত্বেও এস আলমকেন্দ্রিক সাত ব্যাংকসহ নয়টি ব্যাংকে গ্রাহকদের চেক নগদায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এতে দেশে ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজারটির ব্যবসা একেবারে লাটে উঠতে চলেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ীক বলেন, বাজারে পণ্যের দাম ঠিক আছে। ভোজ্যতেলের দাম কিছু হেরফের হচ্ছে। কারণ এস আলমের মিল থেকে তেল ডেলিভারিতে সমস্যা হচ্ছে। এটির সুযোগ নিচ্ছে অন্য মিলগুলো। তিনি বলেন, গত একমাস খাতুনগঞ্জে কোনো ব্যবসা হয়নি। এখন বন্যার কারণে বিক্রি একেবারে কম। পাশাপাশি এস আলমকেন্দ্রিক সাতটি ব্যাংকসহ নয়টি ব্যাংক গ্রাহকদের চেক নগদায়ন করতে সমস্যা করছে। এসব ব্যাংকে আমাদের হিসাবও রয়েছে। ওইসব অ্যাকাউন্টে আমাদের টাকা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমাদের চেক পাস করাচ্ছে না। এতে আমরা বিপাকে পড়েছি। এদিকে গত জুলাইয়ে গ্যাস সংকটে পিছিয়ে পড়ে উৎপাদনমুখী শিল্প। এসব সংকট কিছুটা কাটিয়ে উৎপাদনে ফিরেছে কারখানাগুলো। তবে আগের গতানুগতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু নতুন সমস্যা। এখনো কাঁচামাল সংগ্রহ ও দেশব্যাপী পণ্য সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। খুব বেশি বাড়েনি বেচাকেনাও। পাইকারি বাজারে বরং বেচাকেনা কমেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানার উৎপাদন শুরু হলেও আমদানি হওয়া কাঁচামাল আসা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কাঁচামাল সংকট রয়েছে। এ ছাড়া বিক্রি কমে যাওয়া, ডলারের ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকখাতে অস্থিতিশীলতা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের অভাবের কারণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তারা। চলমান পরিস্থিতিতে নানা ধরনের সমস্যার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলেছেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে দেশে বেশ কিছু শিল্পগ্রুপের কারখানা এখন বন্ধ। সেসব কোম্পানির পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে। আবার যেসব কোম্পানি স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পণ্য সরবরাহকারী অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মালিকও বিগত সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হওয়ায়, এখনো তারা ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। ফলে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে কিছু কোম্পানির। সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিবেশকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারাও তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন না। এদিকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালানোর পর দেশজুড়ে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জ¦ালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও লুট হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে বড় কোনো লেনদেনের সাহস হচ্ছে না তাদের। এদিকে বড় ব্যবসায়ীরাই যখন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেখানে ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরও খারাপ। পাড়া-মহল্লার দোকান, রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অনেকে দোকানপাট খুলতেই পারেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে ২৫ লাখের বেশি খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের বেশির ভাগই লোকসানে পড়েছেন। এদিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। গত কয়েক সপ্তাহের অনিশ্চয়তায় অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অর্থনীতিতে এখন দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। একটি হলো সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। অপরটি হলো অর্থনীতিতে থাকা সংকটগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া।-এফএনএস