ইউসুফ চৌধুরী, পবা : চলতি মৌসুমের শেষ সময়ে রোপা-আমন চাষে কোমর বেঁধে মাঠে নামেন রাজশাহীর পবা উপজেলার ধান চাষী কৃষকরা। মাঠ জুড়ে এখন দেখা যাচ্ছে কৃষক-কৃষাণীদের কর্মব্যস্ততা। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজের সমারোহ। বিলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাতাসে ধানের সবুজ পাতায় দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। দৃষ্টি জুড়ে ছেঁয়ে গেছে কৃষকের শ্রম আর কষ্টে অর্জিত স্বপ্নের পাতার সবুজ রঙের ঢেউ, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঠ জুড়ে কৃষকের জমিতে এখন হাঁটুসমান উঁচু ধানগাছ। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হওয়ায় খালবিল, ডোবা-নালাসহ নিচু এলাকায় জমা হয়েছে কিছু পানি। জমি থেকে এখন আগাছা পরিষ্কার, সেচ ও সার দেওয়া এবং কীটনাশক প্রয়োগের পালা। এই সোনালী স্বপ্নের গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার কৃষক-কৃষাণীরা।
সরেজমিনে উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের আলিমগঞ্জ, হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের আফি নেপালপাড়া, নওহাটা পৌরসভার ভুগরইলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধান গাছের পরিচর্যায় কেউ পরিষ্কার করছেন আগাছা, আবার কেউ দিচ্ছেন রাসায়নিক সার না হয় প্রয়োগ করছেন কীটনাশক, দম ফেলার সময় নেই কৃষকদের। উপজেলার প্রতিটি মাঠ এখন মুখরিত কৃষকদের পদভারে। অধিক ফলনের আশায় কৃষকরা এবার স্থানীয় জাতের পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল ধানের চারা রোপণ করছেন। সারা মাঠ ছেঁয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্নের গুটি স্বর্ণা, সুমন স্বর্ণা, ব্রি-ধান-৪৯, ব্রি-ধান-৫১, ব্রি-ধান-৭৫, ব্রি-ধান-৮৭, ব্রি-ধান-৯৫, ব্রি-ধান-১০৩ সহ বিভিন্ন জাতের ধানের সবুজ পাতার প্রান্তর। ধানের বাম্পার ফলনের আশায় দিন-প্রহর গুনছে এখন কৃষক। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রকৃতির নিয়মে কার্তিক মাসের শুরু থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আমন ধান কাটা মাড়া শেষ হবে। কুষকের গোলায় সোনার ফসল ধান উঠলেই মায়া ভরা মুখে ফুটবে হাসির ঝিলিক এমনটাই প্রত্যাশা। পবা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ রোপা-আমন মৌসুমে ৯ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সমপরিমান জমিতে আমন রোপণ হয়েছে। কৃষকদের সহায়তায় প্রণোদনা হিসেবে উপজেলা কৃষি-সম্প্রসারণ দপ্তর হতে ৮০০ জন কৃষককে রাসায়নিক সার ও আমন বীজ দেওয়া হয়েছে। কৃষকদেরকে এক বিঘা জমির বিপরীতে জনপ্রতি ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি এমওপি ও ১০ কেজি ডিএপি সার দেওয়া হয়েছে।
নওহাটা পৌরসভার সন্তোষপুর খ্রীস্টানপাড়া পল্লীর দিনমজুর শ্রমিক সুনিল বিশ্বাস বলেন, ‘নিজের জমি জায়গা নাই। পরের জমিতে শ্রমিকের কাজ করেই সংসার চলে তাঁর। ধান লাগানো, আগাছা পরিষ্কার ও মাটি কাটাসহ যখন যে কাজ পায় সে কাজই করি। প্রতিদিন সকাল ৭টায় কাজ শুরু করি আর বেলা একটায় ছুটি হয়। মজুরী হিসেবে পাই ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। প্রতিটি জিনিসের দাম যে হারে বৃদ্ধি সে অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরী কম। পরিবারের চার-পাঁচজন সদস্যের এই টাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়।’ একই গ্রামের দিনমজুর শ্রমিক কুতুব উদ্দিন, মিনতি বিশ্বাস, সখিনা বিশ্বাস, আদুরী বিশ্বাস বলেন, ‘নিজের জমি জায়গা বলতে কিছুই নেই, পরের জমিতে বাড়ী করে বসবাস করি। পরিবারের পাঁচ-ছয়জন সদস্যর খাওয়া, তাদের পোশাক, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া খরচ, অসুখের চিকিৎসা, আবার কিস্তির টাকা পরিশোধ সব মিলিয়ে এই মুজুরীর টাকায় সংসারের চাহিদা মেটে না। জিনিসপাতির যে দাম বাজার করতে গেলে মাথা ঘোরে টেনশন হয়। মজুরী একটু বৃদ্ধি হলে ভাল হবে।’ নওহাটা পৌরসভার ভুগরইল এলাকার কৃষক শাহানুর রহমান ও জানে আলম বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে এবার সুমন স্বর্ণা জাতের ধান রোপণ করেছি। ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ ও তদারকি করছে। রোগ বালাই দমন ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাঁদের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করছি। ধান গাছের গ্রোথ ভাল আছে, যদি কোনো দুর্যোগ, রোগ বালাই না হয় তাহলে আশা করছি ধানের ফলন ভালো পাবো। শ্রমিক এবং নিজে ধান ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারে এখন ব্যস্ত আছি। তবে দিন দিন শ্রমিকের মজুরী এবং কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধিতে আবাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদিত ধানের নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।‘
হরিপুর ইউনিয়নের আলিমগঞ্জ এলাকার কৃষক হাসানুল আলম বলেন, ‘চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। রোপা আমন ধান চাষে খরচ কম লাগে। বৃষ্টির পানি ও সেচের ব্যবস্থা ভালো থাকায় ধান রোপণে কোনো সমস্যা হয়নি। আশা করছি এই মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হবে। ধানের ফলন ভালো হলে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসবে। ধান কেটে ঘরে তুলে এবার জমিতে সরিষা ও গম আবাদ করবো।’ হরিপুর ইউনিয়নের আলিমগঞ্জ ব্লকের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমন ধান চাষে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে এবং সময়মতো সার ও সেচ প্রদান করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমরা কৃষকদের জমি নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছি।’
নওহাটা ব্লকের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন দেওয়ান বলেন, ‘রোপা-আমন ধান চাষে কৃষকরা যাতে লাভবান হয়, কোনো প্রকার সমস্যায় না পড়েন সেজন্য প্রতিনিয়ত মাঠ পর্যায়ে থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি ও পরামর্শ অব্যাহত আছে। যেখানেই সমস্যা সেখানেই উপস্থিত হয়ে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসনিম বলেন, ‘অধিক ফলনের জন্য সুষম সার ব্যবহার, পানি সাশ্রয় এবং সার্বিক পরিচর্যায় কৃষকদের সচেষ্ট হতে আমরা সব সময়ই পরামর্শ দিয়ে আসছি। আশা করছি, রোপা-আমন ধানের বাম্পার ফলন পাবেন কৃষকরা। কৃষকদের কল্যাণে ধান চাষে কৃষকের ক্ষেতে পোকামাকড় ও রোগ বালাই প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক তদারকি, সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। আমন ধান চাষে প্রযুক্তির ব্যবহারের সাহায্যে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেও নজর দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। বিশেষ করে কৃষকদের সরকারিভাবে প্রণোদনা হিসেবে উন্নত মানের বীজ এবং সার দিচ্ছে ফলে ধানের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।’