বুধবার

১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৩রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
বিচারকের অভাবে কাটছে না লাখ লাখ মামলার জট পবার ইউএনওকে ইউপি চেয়ারম্যানদের ফুলেল শুভেচ্ছা নওগাঁর এক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা গড়েছেন কয়েক কোটির টাকার সম্পদ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ ও অবসরের ৬৫ বছর বিবেচনার অনুরোধ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেলসন ম্যান্ডেলা পিস এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তিতে মনোনীত হয়েছেন সাংবাদিক শিশির বাংলাদেশকে বাড়তি ২ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলো বিশ্বব্যাংক ক্ষমতাপালা বদলের জন্য গণঅভ্যুত্থানে আসেনি : আসিফ দশবছর এমপি গিরিতে’ই ৫০০ কোটি টাকার মালিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী দারা! শোভাযাত্রায় রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ বিএনপি’র আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

অভিভাবকহীন বিশ্ববিদ্যালয়, সংকটের কারণ দলীয় স্বার্থ

Paris
Update : শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪

চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগের যথাযথ নিয়ম নেই। যুগ যুগ ধরে দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবরই দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউজিসি এই বছরের শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য একটি পৃথক নীতির প্রস্তাব করেছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এর আগেও কোনো সরকার ভিসি নিয়োগের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। ফলে গত তিন দশকে ক্ষমতাসীন দল তাদের অনুগত সিনিয়র শিক্ষকদের একজনকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট মনোনীত তিন শিক্ষকের প্যানেল থেকে ভিসি নিয়োগের বিধান থাকলেও সেখানে শুধু ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকরাই ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাছাড়া দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষমতা চ্যান্সেলরের হাতে রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করার দাবি তুলেছে শিক্ষার্থীরা। বিগত সরকারের আমলে যেসব ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন। তাদের কেউ কেউ অপমানিতও হয়েছেন। তাঁরা সবাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া। এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে চারটি স্বায়ত্তশাসিত। ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকে গত ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ২৮ জন ভিসি পদত্যাগ করেছেন। ১২ জন উপাচার্য ও সাত কোষাধ্যক্ষও পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ১২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি সরকারি কলেজ ও ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেখা গেছে, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের একযোগে পদত্যাগের কারণে বেশ কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে। ফলে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়- এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভিসি নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়েছে। আর সেখানেও নতুন ভিসি নিয়োগ করা হয়েছে সরকারের পছন্দ অনুযায়ী। এ অবস্থায় শিক্ষা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের সময়ে সরকারের পতনের পর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমান সে ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়নি। শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ এখনও রয়েছে। নতুন সরকারকে এটা আমলে নিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকটের বড় কারণ দলাদলি। বিগত সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ শীর্ষ পদে দলীয় আনুগত্য সম্পন্ন শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবরই দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোও ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেয়। ফলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবাসন, মানসম্মত খাবারের মতো নূন্যতম সুযোগ-সুবিধাও পায়নি। তাই ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে শিক্ষার্থীরাও তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রকাশ করে। এসব অভিজ্ঞতাকে আমলে নিয়ে এখন থেকে অনুকরণীয় শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। এটা করার এখনই উপযুক্ত সময় বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও প্রযুক্তি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, উপাচার্য নিয়োগের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিত, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এত বছরেও আমরা তা করতে পারিনি। কিন্তু এখনই এটা করার সঠিক সময়। আমরা কোনো পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা চাই রোল মডেল যারা কর্মক্ষেত্রে মূল্যবোধকে লালন করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারে। একজন শিক্ষকের অবশ্যই একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে হবে, তবে সেই পরিচয় যেন নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্টর হয়ে না যায়। এটা নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নাদিম মাহমুদ বলেন, আসলে, স্বাধীনতার পর দেশে জারি করা অধ্যাদেশ ৭৩ ভিসি নিয়োগের নির্দেশ দেয়। দুটি ধারার মাধ্যমে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিনেট কর্তৃক মনোনয়ন এবং চ্যান্সেলর কর্তৃক মনোনয়ন)। এরপর যখনই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা একইভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম ভিন্ন ছিল, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নামের সঙ্গে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ শব্দ যোগ করে একই নীতিমালা চালু করা হয়েছে, কিন্তু দুটি ধারার প্রথমটি (সিনেট কর্তৃক নিয়োগ) কোথাও যুক্ত করা হয়নি। ফলে উপাচার্যের পদ শূন্য হলেই সেখানে চ্যান্সেলর মনোনীত লোক নিয়োগ করা হয়। তাই সরকার সিনেটের নিয়োগের নিয়মে সম্মত হয়নি, কারণ এইভাবে ক্ষমতাসীন সরকার তাদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ করতে পারে। এই ভিসিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি আমরা গত কয়েক দশকে দেখেছি। মূলত ভিসিরা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ দিয়ে আসছেন। নাদিম মাহমুদ আরও বলেন, উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীকে তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে এবং এর যথাযথ মূল্যায়ন হবে। যোগ্য ব্যক্তিদের অ্যাকাডেমিক এবং নেতৃত্বের গুণাবলি, রাজনৈতিক পরিচয় নয়। উচ্চশিক্ষা সংস্কারের অংশ হিসেবে এই কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু করতে পারে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বেশির ভাগ ভিসি হঠাৎ করেই পদত্যাগ করেছেন, তাই নিয়োগ নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে সরকার। নতুন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে দলবদ্ধ শিক্ষক রাখতে চান না। তারা ভিসি করতে চায় যাদের উচ্চ শিক্ষাগত দক্ষতা এবং গবেষণায় সুনাম রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টাও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় বিএনপিপন্থি শিক্ষকরাও উপাচার্য হওয়ার জন্য লবিং করছেন। ফলে সম্পূর্ণভাবে দলীয় সংশ্লিষ্টতার বাইরে ভিসি নিয়োগ করা কঠিন হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তৎকালীন সরকারের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলস্বরূপ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের সময় শিক্ষকদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে, যেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। এটি উপাচার্য নিয়োগের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
ভিসিরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলো : গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত শিক্ষকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে নিয়োগ পেয়ে কাউকে তোয়াক্কা করেননি। তারা একসাথে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য অনেক শিক্ষককে সুবিধা প্রদান করেছিল। তারা ছাত্রলীগের নেতাদেরও অনুগত রেখেছেন। এ কারণে কোনো অনিয়মের প্রতিবাদ করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হন। এভাবে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন ভিসিরা। এমনকি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ও বিদ্যমান আইনকেও উপেক্ষা করেছে। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, কমিশন গত ১৫ বছরে অন্তত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করেছে। বেশির ভাগ অভিযোগই ছিল স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ অনিয়মের। এ ছাড়া নির্মাণ ও সংগ্রহে অনিয়মসহ আর্থিক দুর্নীতি ছিল। কয়েকজন ভিসি তাদের স্ত্রী, সন্তান ও জামাইকেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান তার অফিসে শেষ দিনে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক শেখ আবদুস সালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী তদন্ত করেছে ইউজিসি। তদন্ত প্রতিবেদনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।-এফএনএস


আরোও অন্যান্য খবর
Paris