শুক্রবার

১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২৬শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পবায় বস্তায় আদা চাষ ও পারিবারিক পুষ্টি বাগানে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের

Paris
Update : মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪

ইউসুফ চৌধুরী : বস্তায় মাটি ভরে আদা চাষে আগ্রহ বাড়ছে পবা উপজেলার কৃষকদের মাঝে। ফলে বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ, অনাবাদি ও পতিত জমিসহ বিভিন্ন জায়গায় বস্তায় মাটি ভরে কিংবা টবে হচ্ছে আদা চাষ। আর এইসব কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে নিতে কাজ করছে উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর। এতে আগ্রহ বাড়ছে অন্য কৃষকদের মধ্যেও। মসলা এবং ভেষজ ওষুধ হিসেবে সারা দেশে আদার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বর্তমান বাজারে এর দামও বেশ চড়া। তাই পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে এবং বাড়তি কিছু আয়ের আশায় কৃষকরা বস্তায় আদা চাষ শুরু করেছেন। এছাড়াও কৃষি কাজে পিছিয়ে নেই গ্রামীন নারীরাও। কৃষিতে অবদান রাখতে পুরুষের হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলছে পারিবারিক পুষ্টিবাগান। পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অনাবাদি, পতিত ও বসতবাড়ির অব্যবহৃত জমি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এতে একদিকে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে মশলা জাতীয় ফসলেরও উৎপাদন হবে। পারিবারিক পুষ্টিবাগান পরিবারের পুষ্টির অভাব ও শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শরীরে শক্তির যোগান দেয়। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর লক্ষে পারিবারিক পুষ্টি বাগান তৈরির ফলে পরিবার নিরাপদ সবজি খেতে পারবে পাশাপাশি আর্থিকভাবে সচ্ছল ও লাভবান হবে। এতে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকার নির্দেশনা বাস্তবায়নে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন হচ্ছে। প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত ও অনাবাদি জমির ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এর ফলে কৃষকের বসতবাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর ও খালের পাড় সহ বিভিন্নস্থানে সবজি ও মশলার চাষাবাদ ফলে মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও নিশ্চিত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব পারিবারিক পুষ্টি বাগান থেকে উৎপাদিত হচ্ছে শিম, বেগুন, মরিচ, ধনিয়া পাতা, সরিষা শাক, পাটশাক, ডাটা শাক, লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক, কলমীশাক, কচুশাক, লাউ, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, বরবটি, করলা, ঢেঁড়শ, পেঁপে, তরই, ঝিঙ্গা, শসা, মুলা সহ বিভিন্ন সবজী ও মসলা। এছাড়া লেবু, আম, ডালিম, পেয়ারা, কলা, আমড়া, জলপাই সহ আরো অনেক দেশীয় ফল। ফলে পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পরিবারগুলোতে বাড়ছে স্বনির্ভরতা।
নওহাটা পৌরসভার কুমড়া পুকুর গ্রামের গৃহবধু জেসমিন খাতুন পাঁচ’শ বস্তা আদা চাষ এবং পারিবারিক পুষ্টি বাগান করেছেন। এই পদ্ধতিতে বাগান করতে কিভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন জানতে চাইলে গৃহবধু জেসমিন বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পবা, রাজশাহীর সহযোগিতায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন এর পরামর্শে করেছি। এখন আর শাক-সবজী কেনা লাগেনা, নিজে খাই, প্রতিবেশিদের দেই আবার বিক্রিও করি তাতে কিছু আয়ও হয়। একই গ্রামের নাসরিন, জোসনা, বেবী, হোসনেআরা বলেন, আমাদের দেখাদিখি গ্রামের আরোও অনেকে আদা চাষ ও পারিবারিক পুষ্টিবাগান করেছে। এই পদ্ধতিটা একেবারেই নিরাপদ। বিষমুক্ত বাগানের উৎপাদিত সবজি তার ও অন্যের পরিবারের চাহিদা মেটাচ্ছে। অল্প জমিতে অনেক সবজি চাষ করা যায়। অনুরোধ করবো এমন একটি নিরাপদ সবজি বাগান যেন সবাই করে।’ হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের ধর্মহাটা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে কৃষকরা বাড়ির আশপাশে বস্তায় আদার চাষ করেছে। ধর্মহাটা গ্রামের মশিউর রহমান তার বাড়ির পাশে পতিত জায়গায় সাড়িবদ্ধভাবে প্রথম বারের মতো দেড় হাজার এবং একই গ্রামের ইমরান খান দুই হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। তারা জানান, ‘আদা চাষে আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। রোগের আক্রমনও কম হয়। বাড়ির আশপাশের পরিত্যক্ত ও ছায়া যুক্ত জায়গা কাজে লাগিয়ে আদা চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়। সফলতা পেলে ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে আদার চাষের পরিমান বৃদ্ধি করবে।’ হরিপুর ইউনিয়নের নতুন কসবা গ্রামের আলাউদ্দিন বলেন, ‘আদা চাষ ও পারিবারিক পুষ্টি বাগান করেছেন। এখন বাগান থেকে পাচ্ছি এবং টাটকা খাবার খাচ্ছি। সেই বাগানের উৎপাদিত সবজি থেকে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে কিছু শাক-সবজি বাজারে বিক্রি করার পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরও দেন। আগে প্রতি মাসে বাজার থেকে শাক সবজি কিনতে যে টাকা খরচ হতো তা পুরোটাই এখন সঞ্চয় হয়।’ নওহাটা ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন দেওয়ান বলেন, ‘এপ্রিল-মে মাস আদা রোপণের উপযুক্ত সময়। বস্তায় আদা চাষ করলে আলাদা জমি অপচয় হয় না। বস্তার মাটি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আদার দাম অনেক বেশি। আমরা কৃষককে আদা চাষে উদ্বুদ্ধ সহ কারিগরি সহায়তা এবং সর্বক্ষনিক প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করছি। আশা করি বস্তায় আদা চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কৃষক বাড়তি আয়ও করবে।’ হরিপুর ইউনিয়নের আলিমগঞ্জ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘অনাবাদি পতিত জমিতে বস্তায় আদা চাষ ও পারিবারিক পুষ্টিবাগান একটি ভাল পদ্ধতি। এইভাবে কৃষকরা সারাবছর ধরে শাক-সবজী ফলমুল খেতে পাবে। বিষমুক্ত নির্ভেজাল খাবার পায়। তাতে শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। বস্তায় আদা চাষ অত্যন্ত লাভজনক। কীটনাশক ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে বিষ টোপ, আঠালো ফাঁদ এবং নেট হাউসের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি, ফল, ভেষজ ও মসলা চাষ হচ্ছে এসব বাগানে। খেতের মাঝে কীটপতঙ্গ দমনে সেক্সফেরোমন ফাঁদ, জৈব সার ও কেঁচো সার ব্যবহার করায় জমির ফসল নিরাপদ থাকে ও খাদ্যমান এবং পুষ্টি সঠিকভাবে পাওয়া যায়।’
হুজুড়ীপাড়া ও ধর্মহাটা ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম ও আকবর আলী বলেন, ‘মাটির সঙ্গে গোবর সার, খৈল, ছাই সহ রাসায়নিক সার মিশিয়ে কৃষকরা পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে বস্তায় আদার চাষ করছেন। পরিত্যক্ত জায়গা ও বাড়ির পাশে মসলা জাতীয় ফসল আদা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বস্তায় আদা চাষে অল্প খরচে লাভবান হবে কৃষক। কৃষকদের ভালো মানের আদার বীজ প্রাপ্তি ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং আদা চাষে সকল প্রকার সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারজানা তাসনিম জানান, ‘যে কোন পরিত্যক্ত জায়গা, বসতবাড়ির চারদিকে ফাকা জায়গা, বাড়ির ছাদে সহজেই আদা চাষ করা যায়। একই জায়গায় বারবার চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ অনেক কম। প্রতি বস্তায় ২৫-৫০ টাকা খরচ করে বস্তা প্রতি ১-২ কেজি আদা উৎপাদন করা যায়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে কন্দ পচা রোগ হয় না। যদিও কখনো রোগ দেখা যায় তখন বস্তা সরিয়ে ফেলা যায়, ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। বস্তায় আদা চাষ করলে নিড়ানিসহ অন্যান্য পরিচর্যার তেমন দরকার হয় না ফলে উৎপাদন খরচ কম হয়। এছাড়াও বস্তায় শাকসবজি, আদা এবং হলুদ ফলানো যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের পরামর্শ ও সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা উদ্ধুদ্ধ হয়ে প্রায় বিশ হাজার তিন’শ পঞ্চাশ বস্তায় আদা চাষ করেছেন। পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টি বাগানেও আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।’


আরোও অন্যান্য খবর
Paris