শাহানুর রহমান রানা : অজ্ঞান পার্টি কিংবা মলম পার্টি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে টাকা পয়সা ও মালামালসহ সর্বস্থ হারিয়েছেন এমন অঘটনের সাথে অনেক আগেই পরিচিত ঘটেছে নগরবাসির। দুষ্কৃতিকারিদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। কিন্তু, নগরীতে নতুন করে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে সেটি পূর্ববর্তীর চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর। অনেকের ভাষায় এটিকে বলা হচ্ছে ‘ডেভিলস্ ব্রেথ’ বা শয়তানের নিঃশ^াস। বিশেষ একধরণের ড্রাগ ব্যবহার করে হিপনোটাইজ পদ্ধতির মাধ্যমে কোন প্রকার বাধাবিঘ্ন বা প্রতিরোধ ছাড়াই পথচারিদের কাছে থাকা টাকা পয়সা, মোবাইল, ঘড়িসহ স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেবার ঘটনা ঘটেছে নগরীতে। গত ৩০ জুন আরডিএ মার্কেটের গেটের সামনে দুইজন ব্যক্তি হিপনোটাইজ পদ্ধতির মাধ্যমে এক মধ্যবয়সী নারীর কাছ থেকে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। বিষয়টি, নামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার পর বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আমাদের রাজশাহী পত্রিকার প্রতিবেদক সরেজমিনে নামে বিস্তারিত জানার জন্য।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের নারকোটিক্স বিভাগের উপপরিচালক মোহাঃ জিললুর রহমান বলেন, হেলুসিনেটিক বিংবা সমজাতীয় ড্রাগসহ কাউকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। তবে, এই ধরণের অবৈধ ড্রাগ মানুষের মস্তিকে একধরণের হ্যালুসিনেশন তৈরি করে। অর্থ্যাৎ, এই ধরণের ড্রাগ নিঃশ^াস কিংবা পানীয়র মাধ্যমে কারো শরীরে প্রবেশ করলে ওই ব্যক্তি হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়েন। শরীরে যতক্ষণ সেটির প্রভাব থাকবে, তিনি যে কোন ব্যক্তি দ্বারা কিছু করতে বাধ্য হয়ে পড়বেন। আমরা তোন নতুন ধরণের মাদক পেলে সেটি আমাদের ‘কীট বক্স’ দ্বারা পরীক্ষা করার পর বলতে পারবো সেটি কোন শ্রেণীর মাদক। তিনি আরো বলেন, ইদানিং, মাদকসেবীরা বিভিন্ন ধরণের ঔষধ কিংবা একাধিক মাদকের সংমিশ্রণে নতুন নতুন নেশা জাতীয় মাদক তৈরি করে সেবন করছে।
একই দপ্তরের সহকারী পরিচালক শাকিল আহমেদ বলেন, এই ধরণের ড্রাগ সাধারণত তৈরি হয় ধুতরার ফুল কিংবা সমজাতীয় উদ্ভিদের ফল-ফুল দিয়ে চেতনা নাশক বেশকিছু ড্রাগ তৈরি করে এর অপব্যবহার করছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, নতুন এ আতঙ্কের নাম ডেভিলস্ ব্রেথ বা শয়তানের নিশ্বাস, যেটি স্কোপোলানিন গোত্রের একধরণের ভয়ংকর হেলুসিনেটিক ড্রাগ। অপরিচিত ব্যক্তি অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কেড়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। বিশেষ করে গায়ে থাকা স্বর্ণালংকার। তবে কোনো ধরনের ভয়ভীতি না দেখিয়ে। নারীরাই এই চক্রের টার্গেট বেশি। নারীর কাছে কখনো সাহায্য চেয়ে, কখনো তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ফাঁদ। এ ধরনের চক্রের ফাঁদে পড়ে ঢাকা ও চট্রগ্রামে অনেক নারীই হারিয়েছেন তাদের মূল্যবান গহনা। রাজশাহীতেও প্রবেশ করেছে এই চক্রের সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্কোপোলামিন নামে একধরনের মাদক দিয়ে বশ করা হয় টার্গেট ব্যক্তিকে। এটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি কাছাকাছি গেলেই নিঃশ্বাসে ওটি টেনে নিয়ে যাবে। আর সেটি যার শরীরে প্রবেশ করানো হয় ১২ মিনিটের মধ্যে অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে তার। রিমোট কন্ট্রাল দিয়ে যেমন টেলিভিশন স্ক্রিন নিয়ন্ত্রণ করা যায়; তেমনি ভাবে ওই ছিনতাইকারি যা বলবেন যার নাকে শুকানো হয়েছে তিনি তাই করবেন। মূলত ওই ব্যক্তি তখন তাদের কথামতো চলবে।
গত ৩০ জুন বেলা ১২ টার সময়, নগরীর আরডিএ মার্কেটের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন মধ্য বয়সী এক মহিলা। পেছন থেকে একটি ছেলে ‘মা শুনছেন’ বলে মহিলার গতিপথ রোধ করে। অপরিচিত ছেলেটি মহিলাকে জিজ্ঞেস করে, “মা! কাশেম কনফেকশনারি চিনেন?” মহিলা উত্তরে বলেন ‘না’। তুমি অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করো।” ঠিক সে সময় পেছন থেকে আরেকটি অপরিচিত ছেলে এসে ঐ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?”। ছেলেটি বলে “আমার কাছে কিছু চিনি আছে। ঐ দোকানে দিতে হবে। আমার কাছে বাড়িতে ফিরে যাবার টাকাও নেই। এই কথা শুনে পরে আসা ছেলেটা ঐ ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে ‘বাসা কোথায়?’ ছেলেটা বলে ‘কিশোরগঞ্জ’। তখন পরে আসা ছেলেটি ১০০ টাকার একটা নোট বের করে ঐ মহিলার মুখের সামনে নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে ঐ ছেলেটিকে ১০০ টাকা দিয়ে মহিলাটিকে বলেন, ‘আন্টি আপনিও ১০০ টাকা দিয়ে ছেলেটিকে উপকার করেন’। ছেলেটা ওর বাড়িতে চলে যাক।’ তার পরবর্তী প্রায় ২০ মিনিট ঐমহিলার আর কিছু মনে নেই। শুধু এইটুকু মনে ছিল যে, চুপচাপ তাদের (দুই ছিনতাইকারী) পিছনে হাঁটতে হাঁটতে সাহেববাজার কাপড়পট্টির ভিতরে সিঁড়ির কাছে গিয়ে কোন কথা না বলেই হাতের ব্যাগ, মোবাইল, গলার স্বর্ণের চেইন, হাতের স্বর্ণের বালা খুলে তাদের হাতে দিয়ে দেন ঐ মহিলা। বিভিন্ন কায়দায় হিপনোটাইজ করে সুকৌশলে কেড়ে নেয়া হচ্ছে সবকিছু।
এই ধাঁচের মাদক টাকা, রুমাল, মোবাইল ফোনের স্ক্রীন কিংবা কাগজের প্যাকেটের গায়ে লাগিয়ে সুকৌশলে কোন ব্যক্তির নিঃশ^াসের সাথে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের মধ্যেই এর কার্যকারিতা শুরু হয়। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে এটি ব্যবহার করলেও এর কার্যকারিতা শুরু হয়ে যায়। নিঃশ^াসের মাধ্যমে শরীরে সেটি প্রবেশ করার পর হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েন মানুষ। সেই সুযোগে মনুষ্য বশীকরণ বিদ্যা বা হিপনোটাইজ এর মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয় সর্বস্থ। হিপনোটাইজ এর বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সম্মোহন করা। সম্মোহন একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা, যেটি মানুষের মনোযোগ বৃদ্ধি, একাগ্রতা এবং পরামর্শ ও নির্দেশ গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
পূর্বে নগরীতে বেশ কয়েকবার মলম ও অজ্ঞান পার্টির ফপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের ২ জুলাই রাজশাহীতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছয় নির্মাণ শ্রমিক। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাদের কাছ থেকে টাকা ও মোবাইলসহ সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। এরআগে, ২০১৫ সালে কুরবানির ঈদের আগে রাজশাহীর সিটি বাইপাস গরুর হাটে অন্তত ২৫ জন গরু ব্যবসায়ী অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ের অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। ২২-০২-২০০৬ তারিখে রাজশাহী নগরীতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে টাকা ও অটোরিকশা খুইয়েছেন এক চালক। তার নাম হাসিব (৩০)। তিনি নগরীর কেদুর মোড় এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে। ২৯-৭-২০২০ তারিখে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় অর্ধ লাখ টাকাসহ হাসান মাহমুদ (২৮) নামে অজ্ঞানপার্টির এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।