শাহানুর রহমান রানা : সারাদেশে ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী মহানগরীতে অত্যাধুনিক সুবিধাসম্বলিত দুটো বহুতল বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ হবার কথা রয়েছে। এরমধ্যে ছোটবনগ্রামে একটি ও বড় বনগ্রাম এলাকায় একটি। ইতোমধ্যেই ছোটবনগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। সূত্রমতে, মোট পাঁচবার ‘রি-টেন্ডার’ প্রক্রিয়ার রোষানল শেষে দশতলা বিশিষ্ট বহুতল বিদ্যালয় ভবনটির কার্যাদেশ পেয়েছে রাজশাহীস্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রয়্যাল-নিপা-হোসেন (জেভি)। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকার আব্দুর রশিদ। সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগ (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের। বহুতল এই বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণ ব্যয় (দরপত্র মূল্য) ধরা হয়েছে ২৫ কোটি ৩৬ লক্ষ ৯১ হাজার ৩৯ টাকা। টেন্ডারের মাধ্যমে গত ১৯-০১-২০২৩ ইং তারিখে ভবনটির নির্মাণ কাজের (পয়ঃনিষ্কাশন পানি সরবরাহ ও বৈদ্যুতিক কাজসহ দশ তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন) যাত্রা শুরু হলেও প্রথম থেকেই ধীরগতির কাজের কারণে স্থানীয়দের সমালোচনার তোপেরমুখে পড়তে হচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে রাসিকের ১৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, নির্মানাধীন এই বহুতল বিদ্যালয় ভবনটির কাজের মান মোটেও সন্তোষজনক নয়। নিম্নমানের কাজ চলমান রেখেই চলছে বহুতল বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণযজ্ঞ। এছাড়া এতো ধীরগতির কাজের জন্য ঠিকাদারের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কাজের মান নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে বলে জানান কাউন্সিলর সুমন।
ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত তথ্য মতে, বহুতল ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা ছিল কার্যাদেশ পাবার তারিখ হতে চব্বিশ মাসের মধ্যে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে পাওয়া কার্যাদেশ মোতাবেক ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখের মধ্যে দশম তলা বিশিষ্ট এই বহুতল ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও ১৬ মাসে সেটির অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশের মতো। সেটিও আবার অসমপন্ন।
প্রকল্পস্থলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বহুতল ভবনের মূল অবকাঠামোর দশ শতাংশের মতো নির্মাণ কাজ এখনো পর্যন্ত অসম্পূন্ন। পাইলিং শেষে প্রথম তলার একাংশের কাজ চলমান রয়েছে। কিছু অংশে চলছে ছাদ ঢালাইয়ের প্রথম পর্বের প্রস্তুতি হিসেবে সাটারিংয়ের কাজ। সেটিও আবার মূলভবনের প্রথম তলার একাংশ মাত্র। শিক্ষানগরী নামে খ্যাতে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এমন কচ্ছপগতির বিষয়টিকে নিন্দনীয় ও পরিকল্পিত কোন দূরভীসন্ধি বলে মন্তব্য সচেতন ব্যক্তিদের। নির্মাণাধীন ভবনটির সামনে যত্রতত্র পড়ে আছে যৎসামান্য নির্মাণ সামগ্রী। ভবনের খুব কাছে ফেলে রাখা হয়েছে দুই থেকে তিন ট্রাক বালু, কয়েক হাজার ইট, সাটারিং কাজে ব্যবহৃত কিছু কাঠ-তকতা, যতসামান্য পাথর, মুহুর্তের মধ্যেই গুণে ফেলার মতো ছোট্ট রডের একটি বান্ডিল। আর আছে কিছু বাঁশ। এই অতিসামান্য নির্মাণ উপকরণের সংগ্রহশালা বা মজুদ নিয়ে কচ্ছপ গতিতে চলছে দশতলা বিশিষ্ট বহুতল ভবনের কাজ। ভবনের সন্নিকটে গিয়ে চোখে পড়ে ভবনের সামনে রোগাক্রান্তবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিটনেস বিহীন একটি ট্রাক, পানি ধারণ ও সরবরাহের জন্য ছোট্ট একটি জং ধরা ট্যাংকার। নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছে মাত্র আট থেকে দশজন শ্রমিক। এতো বড় একটি প্রকল্পে এতো কম শ্রমিক কেনো জানতে চাইলে, সাইড ম্যানেজার স্বাধীন বলেন, আছে তো, আরো শ্রমিক আছে। তারা কোথায়? প্রশ্নের জবাবে তিনি শুরু করেন ‘কাঁচুমাচু’।
কার্যাদেশ পাওয়া মেসার্স রয়্যাল-নিপা-হোসেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক আব্দুর রশিদের কাছে ধীরগতি কাজের কারণ ও নির্মাণ উপকরণের যোগানের স্বল্পতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সয়েল টেস্ট ও ভবনের নকশা হাতে পেতে বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু, নির্মাণ উপকরণের যোগান বা মজুদের পরিধি এতো কম কেনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
এদিকে স্থানীয় ঠিকাদাররা বলছেন, বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হাতে হয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণ লিকুইড ম্যানি নেই, অথবা চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্মাণ সামগ্রীর দাম হ্রাস পেতে পারে সে অপেক্ষায় তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্মাণ উপকরণ ক্রয় করে মজুদ করেননি। ঠিকাদারদের সেই মন্তব্য মিলে যায় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সাথে। এবারের বাজেটে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি দাম কমেছে নির্মাণ উপকরণের। ঠিকাদাররা বলেন, এবারের বাজেটে ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ-সামগ্রীর মধ্যে রড, বার ও অ্যাঙ্গেল তৈরির কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে লোহাজাতীয় পণ্যের দাম কমছে। দেশে উৎপাদিত সুইচ-সকেট, হোল্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে সুইচ-সকেটের দামও কমছে। ইলেকট্রিক মোটর উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ইলেকট্রিক মোটরের দামও কমছে। এসব কারণ বিবেচনায় রেখেই হয়তোবা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ইচ্ছাকৃত ভাবেই নির্মাণের কর্মযজ্ঞে ধীরগতির আশ্রয় নিতে নিয়েছে।
জানতে চাইলে এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী (রাজশাহী জেলা) আব্দুস সালাম বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পেনাল্টি প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে, বোয়ালিয়া অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুস সামাদ মন্ডল বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে না। প্রকল্পের সময় আরো সময় বৃদ্ধি করতে হবে। ভবনের নকশা দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি। দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কাজের অগ্রগতি আনতে হলে এখন থেকে প্রতিমাসে একটি করে ফ্লোরের ঢালাই কাজ শেষ করতে হবে।
স্থানীয়দের মন্তব্য, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চাপ আর প্রকৌশলীদের নিয়মিত তদারকি না থাকায় ধীরগতির কাজ করার পাশাপাশি অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। শিডিউলে উন্নতমানের ইট ও পাথর ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেটির দিকে সুনজর দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে রড ও সিমেন্টের ব্রান্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাই এখানে হেরফের করার তেমন কোন সুযোগ না থাকলেও ভবনের বিভিন্নস্থানে মরিচা ধরা পুরোনো রড ব্যবহার, ছাদের ঢালাইকাজে বিছানো রডের দূরত্বসহ ছাদের থিকনেস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় ঠিকাদারদের মাঝে।
এদিকে, স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণের অনুপাতেও রয়েছে গাফলতি। বালি ব্যবহার বেশি হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। বিষয়গুলোর সত্যতা যাচাই করে কাজের মানে আরো বেশি উন্নয়ন ও তরাণি¦ত করার দাবি স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের।
ভবন নির্মাণ প্রকল্পের চলমানবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাঈদের সাথে কথা বললে তিনি জানান, সয়েল টেস্ট করতে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। এছাড়াও ভবনের নকশার পরিবর্তন হবার কারণে সেখানেও কালবিলম্ব হয়েছে। তবে, কাজের মানে কোন হেরফের হচ্ছেনা বলে দাবি নির্বাহী প্রকৌশলীর। প্রকল্পস্থলে সর্বদাই দুইজন করে প্রকৌশলী থাকার দাবি করেন তিনি। কিন্তু বেশ কয়েকবার প্রকল্পস্থলে সরেজমিনে গিয়ে ঠিকাদারের সাইড ম্যানেজার ব্যতীত কাউকেউ চোখে পড়েনি।