শুক্রবার

১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রহনপুরে আমের জমজমাট বাজার

Paris
Update : মঙ্গলবার, ৬ জুন, ২০২৩

গোমস্তাপুর সংবাদদাতা

বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলের মধ্যে আম হচ্ছে অন্যতম। আর এই লোভনীয় ফলটির বেশিরভাগ উৎপাদন হয় দেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর মানুষের আয়ের বিরাট উৎস হল এই আম। আম মৌসুমের তিন মাসের আয় দিয়ে সারা বছর সংসার চলে এমন পরিবার ও রয়েছে। অর্থকরী ফসল আম চাষ করে এবং বিক্রয়ের উপযোগী করে বাজারে আম ফল বিক্রয় করে মানুষ তার আয়ের পথকে সুগম করে।

বর্তমানে চলছে আমের মৌসুম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবকটি উপজেলায় আম চাষী এবং আম ব্যবসায়ীরা প্রচন্ড ব্যস্ততম দিন পার করছে। বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাজার হচ্ছে রহনপুর আম বাজার। প্রতিদিন সকাল থেকেই গভীর রাত পর্যন্ত আমের কেনাবেচা থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত করার কাজ চলে এই রহনপুর আম বাজারে। আমের সাথে সংশ্লিষ্ট আম চাষী, আম ব্যবসায়ী, ফরিয়া, শ্রমিক,  ট্রাক মালিকও চালক, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছে। বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রতিদিনের আয় দিয়ে তাদের সংসার চালানো সহ বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন নেওয়া, কিস্তি পরিশোধ এবং সামনে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে  সঞ্চয়ের পরিকল্পনা চলছে।  রহনপুর আম বাজারে এখন বিভিন্ন জাতের আমের দেখা মিলছে। আমের মধ্যে সেরা জাত গোপাল ভোগ দিয়ে শুরু হয় আমের ব্যবসা। এখনো বাজারে গোপালভোগ জাতের আম পাওয়া যাচ্ছে।  যা বাজারে বিক্রয় হচ্ছে  মন প্রতি ১৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ২২০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন জাতের গুটি আম যা বাজারে বিক্রয় হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। এরই মধ্যে ল্যাংড়া জাতের আমও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রয় হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকার মধ্যে।গিরিয়াদাগি আম বিক্রয় হচ্ছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। কালি ভোগ আম বিক্রয় হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। লক্ষণ ভোগ আম বিক্রয় হচ্ছে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। দেশের জিআইপন্য  খিরসাপাত আম  বিক্রয় হচ্ছে ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে।

এছাড়া অনেক প্রজাতির আম পাওয়া যাচ্ছে রহনপুর বাজারে। প্রতিদিন  রহনপুর আম বাজার থেকে প্রায় ছোট বড় দেড়শ ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে আম পরিবহনের সাথে যুক্ত রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়িযোগে আম পরিবহনের ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমের বেপারীগণ ইতিমধ্যেই রহনপুরে চলে এসেছেন। তারা অবস্থান করছেন আম আড়তদারদের  কাছে। সকাল হলেই আম বাজারে গিয়ে আম কিনছেন। তারপর প্যাকেটজাত করে ট্রাকযোগে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠাচ্ছেন। এছাড়া অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত তাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষীদের জন্য আম ক্রয় করে কুরিয়ার সার্ভিস যোগে পাঠাচ্ছেন। কেউবা তাদের নিজস্ব বাগানের উৎপাদিত আম পছন্দের লোকদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত আমের জন্য বহনকারী সধহমড় ঃৎধরহ চালু হয় নাই। যদিও ঘোষণা রয়েছে আগামী ৮ জুন থেকে ম্যাংগো ট্রেন চালু হবে। এই ম্যাঙ্গো ট্রেনটি প্রতিদিন  রহনপুর থেকে বিকেল চারটায় ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

মৌসুম আসলেই আম খাওয়ার জন্য ঢাকা চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কাছে অনুরোধ আস্তে থাকে। কারণ এই রসে ভরা ফলটি খেতে অনেক তৃপ্তিদায়ক। তাইতো এই এলাকার মানুষের কাছে আম পরিচিত হলেও প্রতিদিনের খাবারের সাথে আম না থাকলে যেন জমে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের বিখ্যাত খাদ্য চিতায়ের সাথে আম, পান্তা ভাতের সাথে আম এবং রুটির সাথে আম যেন মিলেমিশে  একাকার।

আমের মৌসুম আসলেই রাজনীতিবিদরা উপরের নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আম পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সামনেই জাতীয় নির্বাচনের  হাওয়া বইছে। শুরু হয়েছে সম্ভাব্যপ্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ। আর তাইতো কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নজরে পড়ার জন্য সবাই আম পাঠাচ্ছেন।

আম ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন জাতের আম রয়েছে। বাজার বড় মোটামুটি। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার খরচের মাত্রাটা একটু বেশি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে কাটুন যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে আম পাঠানো হতো কিংবা অন্য কোন উপায়ে। কিন্তু বর্তমানে আম পাঠানো হচ্ছে ক্যারেট যোগে। শ্রমিকদের বিল ও বেড়েছে। সব মিলিয়ে এক মন আম প্যাকেট করতে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। তবুও শান্তি কিছু দিন পূর্বে একটি ভয়াবহ ঝড় হয়েও বাজারে এখন প্রচুর আম রয়েছে।

আম আড়তদার আশিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এইবারও তিনি আমের বেপারীদের জন্য আম ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন। যদিও কিছু কিছু বেপারী বর্তমানে রহনপুর অবস্থান করছে তবুও অনেকে না আসার ফলে তাদের জন্য আম পাঠাতে হচ্ছে। তিনি বলেন প্রতিবছর আমের আড়তে আম ব্যবসার মাধ্যমে তিনি ভাল উপার্জন করে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

তরুণ উদ্যোক্তা ও অনলাইন আম ব্যবসায়ী ফেরদৌস ইসমাল বলেন, এখন গোপালভোগ আম শেষের পথে। এবার অনলাইন ব্যবসায়ীরা আম বিক্রি করে ভালো লাভবান হচ্ছে। জেলাতে আনুমানিক অনলাইনের আম ব্যবসার সাথে ৭০০ থেকে ৮০০ বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উদ্যোক্তারা সম্পৃক্ত। এবার আমের উৎপাদন ভালো হওয়ার কারণে পাইকারি বাজারে আমের দাম কম হলেও অনলাইনে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ব্যবসায়ীদের সম্মান রক্ষার্থে ভালো মানের সেরা আম অনলাইন গ্ৰাহকদের সরবরাহ করতে হচ্ছে।

কুরিয়ার সার্ভিসের সাথে যুক্ত সাংবাদিক নাহিদ বর্তমানে প্রচন্ড ব্যস্ততম সময় পার করছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন থেকে কুরিয়ারে প্রতিদিন ১০০ ক্যারেট মতো আম দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। বিশেষ করে অনলাইন ব্যবসায়ীদের আম বাগান বেশী। আমরা ঢাকার ভিতরে ১৫ টাকা কেজি ও ঢাকায় ১০ টাকা কেজি করে নিয়ে থাকি।

রহনপুর আম আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুল আজিজ বলেন, বর্তমানে  আমের বাজার মন্দা। বেচাকেনাও কম হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি তীব্র গরমের কথা উল্লেখ  করেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত  গরমের কারণে আম পেকে যাওয়ায় আম চাষি ও  ব্যবসায়ীরা  বাজারে  আম নিয়ে আসছে। প্রচুর পরিমাণে আম বাজারে আসলেও বিক্রির  পরিমাণ কম। দামও কম। ফলে ব্যবসায়ীরা হতাশ। তবে আবহাওয়া  ভাল হলে পরিস্থিতির উন্নতি  হবে বলে তিনি আশা করেন।

রহনপুর  আম ব্যবসায়ী উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বাবু বলেন, বর্তমানে আম ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। কারণ আম চাষীরা  আশানুরূপ  দাম পাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন,  দেশের অন্য ¯হানের  আমে ব্যাপক ফরমালিন মিশিয়ে সেই আমকে চাপাইনবাবগ›েজর আম হিসেবে চালিয়ে দেওয়াতে আমাদের এলাকার  বিষমুক্ত আমের মান ভালো হলেও  দেখতে খারাপ লাগায় বিক্রয়  কম হচ্ছে।  তবে তিনি গর্ব করে বলেন, চাঁপাই যেহেতু আমের রাজধানী তাই আমও সেরা চাপাইনবাবগ›েজর। গোমস্তাপুর উপজেলা আম চাষি ও আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফতাব হোসেন লালান বলেন, বর্তমানে আবহাওয়া অত্যন্ত কড়া। অতিরিক্ত  গরমের কারণে  মানুষ অ¯িহর। আমও গাছে রাখা  সম্ভব হচ্ছে  না। তাই বাজারে নিয়ে আসতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।  তবে দাম কম থাকায়  আমচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আমের ক্রেতারা  খুব সাশ্রয়ী  দামে  আম পাচ্চেন। গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার বলেন, চলতি মৌসুমে ৪ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে ৪১ হাজার ৯৪৪ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত বছর চিলো ৩৭ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন  উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। এবার উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হলেও তুলনামূলকভাবে তেমন ক্ষতি হয়নি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris