শনিবার

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভূমিকম্প প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

এফএনএস : ভূমিকম্প হলো, ভূমির অভ্যন্তরে আকস্মিক সৃষ্ট কম্পনের দরুন আকস্মিকভাবে ভূমির যে কম্পন হয় তাকে ভূমিকম্প বলে। যেমন একটি শান্ত পুকুরে টিল ছুড়লে যেভাবে ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখানে তরঙ্গ শক্তির উৎপত্তি হয় সেখান থেকে মুক্ত শক্তি টেউয়ের মতো শিলায় তরঙ্গের সৃষ্টি করে এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক কারণ অনেক ধরনের হতে পারে। পাত সঞ্চালন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপত, ভূ-পাত, হিমানী সম্প্রপাত, শিলাচ্যুতি, ভূ-গর্ভস্থ বাষ্প এবং ভূ-গর্ভে চাপের হ্রাস প্রভৃতি কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। গ্রামগঞ্জে আবার ভূমিকম্প নিয়ে অনেক অমূলক গল্প শোনা যায়, আগের যুগে গ্রামগঞ্জে প্রচলিত ছিল, যে পৃথিবীটা একজন ফেরেশতার শিংয়ের ওপর রয়েছে, ওই ফেরেশতা যখন শিং পরিবর্তন করে, তখন ভূমিকম্প হয়। কোরআন-হাদিসে এই বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই। অন্য ধর্মেও ভূমিকম্প নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে বা ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় জাপানি এক দ্বীপে মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল নামাজু নামের বিশাল এক ক্যাটফিশ। পৌরাণিক কল্প কাহিনিতে বলা হয়, অনেক ভূমিকম্প হয়েছিল এই মাছটির কারণে। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, সমুদ্রের দেবতা পজিডন রেগে গিয়ে পৃথিবীর ওপর আঘাত করলে ভূমিকম্প হতো। হিন্দু পুরাণে আছে এই পৃথিবীকে ধরে রেখেছে আটটি হাতি। এই হাতিগুলো দাঁড়িয়ে আছে একটি কচ্ছপের পিঠের ওপর। আর ওই কচ্ছপটি ছিল কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা একটি সাপের ওপর। এই প্রাণীগুলোর যেকোনো একটি যখন নড়ে উঠত তখনই ভূমিকম্প হতো। (বিবিসি)
তবে নবীজি (সা.)-এর ভাষ্যমতে অধিক ভূমিকম্প কিয়ামতের পূর্বাভাস। মানুষের পাপের কারণে পৃথিবীতে ভূমিকম্প বাড়বে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথরবর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহ রাসুল? তিনি বলেন, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদপানে সয়লাব হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২২১২)
আল কোরআনে ভূমিকম্প নামের সুরা
পবিত্র কোরআনে ‘জিলজাল’ নামে একটি সুরা আছে। আরবি ‘জালজালাহ’ শব্দের অর্থ হলো, প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি দেওয়া, ভূকম্পিত হওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে সারা বছরে লাখ লাখ বার ভূমিকম্প হয়, তবে এর মাত্রা কম হওয়ায় কিংবা একটি জনবসতির বাইরে হওয়ায় আমরা তার বেশির ভাগই টের পাই না। (বিবিসি)
কোরআনের ভাষ্যমতে কিয়ামতের দিন প্রচণ্ড ভূমিকম্প হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবী যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে। আর জমিন তার বোঝা বের করে দেবে।’ (সুরা : জিলজাল, আয়াত : ১-২)
এমনকি ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়াও কিয়ামতের লক্ষণ। নবীজি (সা.) কিয়ামতের যে কয়টি লক্ষণ বাতলে গেছেন, তার মধ্যে একটি হলো, কিয়ামতের আগে ভূমিকম্প বেড়ে যাবে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে, খুনখারাবি বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে তা উপচে পড়বে।’ (বুখারি, হাদিস : ১০৩৬
ভূমিকম্প কী বাড়ছে?
ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। এই স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানেই ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। স্ট্যাটিস্তা নামক একটি পরিসংখ্যান ওয়েবসাইট ২০০০ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে হওয়া ভূমিকম্পগুলোর একটি চার্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে পাঁচ মাত্রার ওপরে আঘাত হানা ভূমিকম্পগুলোর হিসাব দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০০০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের তথ্যমতে ২০০০ সালে বিশ্বব্যাপী আঘাত হানা ৫ মাত্রার ওপরে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সংখ্যা ছিল ১৫০৫টি, যা ২০২১ সালে এসে ২২০৬টি দাঁড়িয়েছে। এর মাঝখানের বছরগুলোতে অবশ্য এর সংখ্যা ওঠা-নামা করেছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ভূমিকম্প হয়েছিল ২০১১ সালে। ২০১১ সালে ৫ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হয়েছিল ২৪৮১টি। এর পরিসংখ্যানটি বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীতে ভূমিকম্পের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। (সূত্র : ংযড়ৎঃঁৎষ.ধঃ/বলঁউ৮)
বলা যায়, কিয়ামতের অন্য নিদর্শনগুলো যেমন প্রকাশ পেয়েছে এবং সেগুলোর মাত্রা বাড়ছে, তেমনি ভূমিকম্পের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
ভূমিকম্প কি সবার জন্য শাস্তি?
ভূমিকম্প কারো কারো জন্য আজাব। যেমন শোয়াইব (আ.)-এর জাঁতি যখন তাঁকে অস্বীকার করল এবং তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্র করল, তখন মহান আল্লাহ ভূমিকম্প দিয়ে তাদের এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করলেন, যাতে তারা সে জনপদই কোনো দিন বাসই করেনি। যে এলাকা হতে তারা রাসুল ও তার অনুসারীদের বের করার জন্য প্রস্তুত ছিল আল্লাহর আজাব আসার পর সে এলাকার অবস্থা এমন হলো, যেন তারা এখানে বাসই করত না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর ভূমিকম্প তাদের পাকড়াও করল। তারপর তারা তাদের গৃহে উপুড় হয়ে মরে রইল। যেন শোয়াইবকে অস্বীকারকারীরা সেখানে কোনো দিন বসবাস করেনি। যারা শোয়াইবকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৯১-৯২)
তবে মুমিনের জন্য এ ধরনের দুর্যোগ শাস্তি নয়, কোনো মুমিন এ ধরনের দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে নবীজি (সা.) তাকে শহীদ বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি যখন কোনো পথ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় কাঁটাযুক্ত (বৃক্ষের) শাখা দেখতে পেয়ে সে তা তুলে ফেলল। আল্লাহ তাআলা তার এই কাজটি গ্রহণ করলেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দিলেন। [রাসুল (সা.)] আরো বলেছেন, শহীদ পাঁচ প্রকার (১) প্লেগাক্রান্ত (বা মহামারিতে মৃত), (২) পেটের পীড়ায় মৃত, (৩) যে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে, (৪) ভূমিকম্পে কিছু চাপা পড়ে যার মৃত্যু হয়েছে এবং (৫) আল্লাহর পথে যে ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন।’ (মুয়াত্তায়েম মালেক, হাদিস : ২৮৫)
এবং মুমিনের ওপর আগত বড় বড় বিপর্যয়ের কারণে অনেক সময় মুমিনের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আবু মুসা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার এ উম্মত দয়াপ্রাপ্ত, পরকালে এদের কোনো শাস্তি হবে না, আর ইহকালে তাদের শাস্তি হলো, ফিতনাসমূহ, ভূমিকম্প ও যুদ্ধবিগ্রহ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৭৮)
যেসব মুমিন এ ধরনের বিপর্যয়ে বেঁচে যায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এগুলো তাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। এ সময় ধৈর্য ধারণ করলে মহান আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫)
অতএব কেউ কোনো দুর্যোগের শিকার হলে বা মারা গেলে তাদের ব্যাপকভাবে দোষারোপ করা যাবে না; বরং নিজেরাও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। এবং সাধ্যমতো তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

 


আরোও অন্যান্য খবর
Paris