শনিবার

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিপুল অর্থ পাচারের আশঙ্কা

Paris
Update : শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২২

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির নামে বিপুল অর্থ বিদেশ পাচারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ গুণেরও বেশি ব্যয় হয়েছে। মূলধনি যন্ত্রের আমদানি ব্যয়ে এত বড় উল্লম্ফন অস্বাভাবিক। আশঙ্কা করা হচ্ছে আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে প্রায় ১৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের আমদানিকারকরা এ বাবদ ৩০৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল। ওই হিসেবে গত অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৩৩৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছিল। তখনও মূলধনি আমদানিতে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে সীমিত ছিল। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এক বছরের ব্যবধানে মূলধনি পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিবিদরা স্বাভাবিক মনে করছে না। কারণ ওই এক অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় লাফিয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর যেসব খাতে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে তার অন্যতম হলো মেকানিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্স (এইচএস কোড ১৬৮৪২৪)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ওই ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার শতাংশ বেড়ে ওই জাতীয় পণ্য আমদানি দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৭৪ লাখ ৩৮ হাজার ডলার। যার অধিকাংশই চীন থেকে এসেছে। একইভাবে জাহাজে পণ্য ওঠা-নামা করানোর ডেরিক ও ক্রেন আমদানিতেও (এইচএস কোড ১৬৮৪২৬) বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২০২০-২১-এ ডেরিক ও ক্রেন আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬ হাজার ডলার আর ২০২১-২২-এ ব্যয় হয়েছে ৯৩ কোটি ১ লাখ ডলার। ওই হিসেবে এ অর্থবছরে পণ্যটিও আমদানি ব্যয় বেড়েছে দেড় হাজার শতাংশেরও বেশি। পণ্যটির মূল উৎস চীন। তাছাড়া গত অর্থবছরে শিপবোর্ডস ও ফ্লোটিং স্ট্রাকচারের মতো মূলধনি সম্পদের ক্ষেত্রেও আমদানি ব্যয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগই চীন ও জাপান থেকে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে মূলধনি যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ বিবেচিত এমন অনেক পণ্যের উল্লেখ আছে যেগুলোর আমদানি ব্যয় ৭০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে আমদানি ঋণপত্রে ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে চলতি পঞ্জিকাবর্ষে (২০২২ সাল) ঋণপত্রে কমপক্ষে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর এক অনুষ্ঠানে জানান, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে শুধু আমদানির জন্য গড়ে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। তাতে ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে কিনা তা দেখতে গত বছর ও চলতি বছরের অনেক এলসির তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাই শুরু করে। গত জুলাই থেকে যাচাই-বাছাই চালিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে দাম বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। দেশে মূলত মূলধনি যন্ত্রের বেশির ভাগই শূন্য শুল্কে আমদানি হয়। তাছাড়া এ এক বছরে এমন কোনো বড় বিনিয়োগও হয়নি, যার জন্য বিপুল পরিমাণে মূলধনি যন্ত্র আমদানির প্রয়োজন পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ চলে যায় তার ৮০ শতাংশই হয় ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হয়। বাংলাদেশে বেশি মূলধনি যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন থেকে আমদানি হয়। আবার চীনের সঙ্গেই বাণিজ্য পরিসংখ্যান নিয়ে বেশি গরমিল দেখা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের সঙ্গে চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায় দুই দেশের সরকারিভাবে প্রকাশিত বাণিজ্য তথ্যে গরমিল ৫৬৮ কোটি ডলারেরও বেশি। এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, মূলত পুরনো এলসির অর্থ পরিশোধই মূলধনি যন্ত্রের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। মূলধনি যন্ত্রের অর্থ পরিশোধ বাবদ যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে সেখানে আগের বছরগুলোয় খোলা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধও আছে। তাছাড়া সেখানে বিদ্যুৎ খাত ও স্পিনিং মিলের পরিসংখ্যানও আছে। সরকারের প্রকল্পের পরিসংখ্যানও সেখানে থাকতে পারে। গত ৩ বছর কোনো শিল্পেরই তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। বছর তিনেক আগে বস্ত্র খাতে স্পিনিং মিলগুলোর এলসি খোলা হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে সেগুলোর অর্থ পরিশোধ হয়েছে। পরিসংখ্যানে মূলত বিলম্বিত অর্থ পরিশোধের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। শিল্প খাতে মূলধনি যন্ত্র আমদানি বাবদ ওভার ইনভয়েসিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, আমদানীকৃত মূলধনি যন্ত্রের মধ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো বস্ত্র খাতেরই রয়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্পগুলোয়ও অনেক মূলধনি যন্ত্র আমদানি হয়েছে। সেগুলোর প্রভাবও থাকতে পারে। বস্ত্র খাতে মূলধনি যন্ত্র বেশির ভাগই এখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসে। সেক্ষেত্রে দাম বেশি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। রিফাইনারি শিল্পের পাশাপাশি এলপিজি প্রকল্পগুলোর পরিসংখ্যানও মূলধনি যন্ত্র আমদানির হিসাবের মধ্যে আছে। আবার সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রও আছে। সব মিলিয়েই আমদানি ব্যয়ের আকারটা অনেক বড় দেখাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) লিমিটেডের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, এক বছরের ব্যবধানে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় কেন এত বেড়েছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পরিসংখ্যানটি অবশ্যই উদ্বেগের জন্ম দেয়। সেক্ষেত্রে যদি অর্থ পাচার হয় তা খতিয়ে দেখতে হবে। কোন ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ হয়েছে সেটিও বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আর কোন পণ্যে হয়েছে সেটিও জানা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবশ্যই এ নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

 


আরোও অন্যান্য খবর
Paris