শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কিছুতেই কাটছে না সড়কের বেহাল দশা নিয়মের তোয়াক্কা নেই পথচারীদের মধ্যেও

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২২

নানা আলোচনা-সমালোচনা, পরিকল্পনা ও পদক্ষেপেও সড়কের বেহাল দশা কাটছে না। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে তাজা তাজা প্রাণ, গুরুতর আহত হওয়াসহ স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে অনেককে। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না। এর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা ও অতিরিক্ত গাড়ি এবং চালকদের অসাবধানতা দায়ী হলেও পথচারী ও যাত্রীদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদ থেকে জানা যায়, সারা দেশে গত নভেম্বরে ৪৬৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৫৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭৪৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৮টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ২২ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ৭৮ জন ও শিশু ৭১ জন। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে ১৯৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২২৯ জন, যা মোট নিহতের ৪১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৯০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২২ দশমিক ২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯ জন, যা মোট নিহতের ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। নভেম্বরে ৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত ও ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। একই সময়ে ৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৯২টি বা ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১৪৮টি বা ৩১ দশমিক ৯৬ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে, ৭৪টি বা ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ গ্রামীণ সড়কে, ৪৩টি বা ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শহরের সড়কে এবং ৬টি বা ১ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘটেছে অন্যান্য স্থানে। এদিকে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সারাদেশে দুই হাজার তিনটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই হাজার ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন এক হাজার ২৮৬ জন। নিহতদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪৭ জন ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী এবং ৭৩ দশমিক ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ৫৩৩ জন ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী। এসময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সারাদেশে ৭৬৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। যা মোট মৃত্যুর ৩৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ৯২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট মৃত্যুর ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এদিকে রাজধানীসহ পুরো দেশের সড়ক-মহাসড়ক পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, পরিবহন চালক আর পথচারী- কেউই নিয়মকানুনের ধার ধারেন না। খেয়ালখুশিমতো চলেন তারা। হেডফোন কানে লাগিয়ে বা হাতের নাগালে ফুটওভারব্রিজ রেখে অভ্যাসগত দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে চলন্ত যানবাহনের সামনে পড়ে যাওয়া তো হরহামেশাই ঘটছে। এতে বাড়ছে পথচারীদের মৃত্যুর মিছিল। অন্যদিকে রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী উঠানো-নামানোয় সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজটের। হাতেগোনা কিছু সংখ্যক বাসের অনুমোদন নিয়ে এক একটি কোম্পানি শতাধিকের বেশি বাস পরিচালনা করছে রাজধানীতে। শহরের মধ্যে নিদিষ্ট বাসস্ট্যান্ড থাকলেও সেখানে দাঁড়াতে যেন অনীহার শেষ নেই। আবার বাসের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অবৈধভাবে রাস্তার দুপাশে এলোমেলোভাবে গাড়িগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে সরু রাস্তাকে আরও সরু করে ফেলেছে তারা। যেখানে-সেখানে গাড়ির ইউটার্ন নেয়া, সড়কের ওপর এবং ফুটপাতে দোকান তো আছেই। আর বাসের দিকে তাকালে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি যে নিত্যদিনের ঘটনা সেটা বুঝতে আর গবেষণার দরকার হয় না। মোটের ওপর নিজের গন্তব্যের চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা মনে হয় কারও মাথায় কাজ করে না। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ দেশে এখন যে যত কৌশলে ট্রাফিক আইন অমান্য করতে পারবে, সে ততই তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছবে; আর যে আইনের প্রতি যত শ্রদ্ধাশীল হবে গন্তব্যে পৌঁছতে তার ততবেশি সময় লাগবে। অপরদিকে রাস্তায় চলতে গেলে প্রতিনিয়ত জীবন নিয়ে শঙ্কা জাগে। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানের বিষয়ে যোগাযোগবিদরা বলছেন, পথচারীদের পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ টেকসই ও পরিবেশসম্মত করা কোনো সমাধান নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় মানুষের দাবির মুখে, কখনও আন্দোলন সামাল দিতে অথবা দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে যত্রতত্র এসব ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নাগরিকদের সুবিধার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দেশে বিদ্যমান ট্রাফিক আইন সবাই যদি সঠিকভাবে মনে চলেন, তাহলে প্রায় ৩০ শতাংশ অব্যবস্থাপনা দূর করা সম্ভব। এদিকে জনবহুল ঢাকায় পথচারী চলাচল বা পারাপারে তেমন কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। কিছু জায়গায় সেই সুবিধা থাকলেও পথচারীদের উদাসীনতায় তা কোনো কাজে আসছে না। এ ছাড়া রাজধানীতে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় ফুটওভারব্রিজ তৈরির পাশাপাশি ভাঙা ফুটপাতে হাঁটার অবস্থা নেই বললেই চলে। আবার এই ফুটপাতেই বসানো হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন বক্স এবং নামানো হয়েছে ফুটওভারব্রিজের সিঁড়ি। তবে কিছু ক্ষেত্রে পথচারীর দায় থাকা সত্ত্বেও আইনি পদক্ষেপে কখনও পথচারীকে দায়ী করা হয় না। এমনকি জরিমানা ও মোবাইল কোর্ট বসিয়েও পথচারীদের শৃঙ্খলায় আনতে এবং সচেতন করতে সরকারের কোনো চেষ্টাই এখন পর্যন্ত খুব ফলপ্রসূ হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ট্রাফিক পুলিশের ওপর দায় দিলে চলবে না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ সড়কের জন্য বিআরটিএ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। জনসাধারণকেও সচেতন করতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই শৃঙ্খলা আসতে পারে।

 


আরোও অন্যান্য খবর
Paris