শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

৩৮ বছর বয়সেই বিশ্বসেরা শীর্ষ ধনীর কাতারে টিকটক’র ঝ্যাং

Paris
Update : বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২২

টিকটকের নাম শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া ভার। ব্যবহার না করলেও অ্যাপটি সম্পর্কে জানেন অথবা এর ভিডিও দেখেছেন প্রায় সবাই। বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় এই অ্যাপটির নির্মাতার নাম ঝ্যাং ইমিং। বয়স মাত্র ৩৮। এই বয়সেই বিশ্বসেরা ধনীর তালিকায় ২৫ নম্বরে উঠে এসেছেন। জন্মস্থান চীনে রীতিমতো দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন : ঝ্যাং ইমিংয়ের জন্ম ১৯৮৩ সালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ফুজিয়ান প্রদেশে। তার বাবা-মা দুজনই ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। ২০০৫ সালে নানকাই ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন ঝ্যাং। সেখানে শুরুর দিকে তার প্রধান বিষয় ছিল মাইক্রোইলেক্ট্রনিকস। কিন্তু সেটি মনঃপুত না হওয়ায় পরে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে ঝোঁকেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ঝ্যাংয়ের। ঝ্যাং ইমিংয়ের নামটা নেওয়া হয়েছে একটি চীনা প্রবাদ থেকে, যার সারমর্ম ‘প্রথম পদক্ষেপেই কাউকে চমকে দেওয়া’। ঝ্যাং তার নামের যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। তবে এই পথটা এতটাও মসৃণ ছিল না।
কর্মজীবনের শুরু : গ্রাজুয়েশন শেষ করে ঝ্যাংয়ের প্রথম চাকরি ছিল কুক্সুন নামে একটি ডিজিটাল ট্রাভেল বুকিং স্টার্টআপে। সেখানকার অভিজ্ঞতাই তাকে নিজের কোম্পানি খুলতে সাহায্য করেছিল। ঝ্যাং বলেন, আমি কুক্সুন নামে একটি কোম্পানিতে যোগ দেই। সেখানে আমি ছিলাম প্রথম কর্মচারীদের একজন। শুরুতে একজন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেই হয়ে উঠি ব্যাক-এন্ড প্রযুক্তি ও পণ্য সম্পর্কিত নানা কাজের ৪০ থেকে ৫০ জন লোকের ইনচার্জ। এই দ্রুত উত্থান ও দক্ষতা আয়ত্তে আনার সহজাত ক্ষমতাই ঝ্যাং ইমিংকে চলতি দশকের সেরা উদ্যোক্তাদের একজনে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছে। কুক্সুনে চাকরির অভিজ্ঞতা বিষয়ে ঝ্যাং বলেন, সেই সময়ে আমি প্রযুক্তির দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু যখনই কোনো পণ্যে সমস্যা হতো, আমি সক্রিয়ভাবে আলোচনায় অংশ নিতাম। অনেকেই বলতেন, আমার এমনটি করা উচিত নয়। কিন্তু আমি বলতে চাই, দায়িত্ববোধ ও কাজগুলো ভালোভাবে করার আগ্রহ আপনাকে আরও কিছু করতে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে ধাবিত করবে। ঝ্যাংয়ের এমন নিবেদিত মনোভাব ও সমস্যা সমাধানের উদ্দীপনা একপর্যায়ে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগের জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়। ওই চাকরি থেকে পাওয়া বিক্রয় দক্ষতার শিক্ষাই তাকে নিজ কোম্পানি বাইটড্যান্সের উন্নতিতে সাহায্য করেছে বলে বিশ্বাস করেন তরুণ এ উদ্যোক্তা। ঝ্যাং বলেন, আমার মনে আছে, ২০০৭ সালের শেষের দিকে আমি বিক্রয় পরিচালকের সঙ্গে ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমাকে কোনটি ভালো বিক্রি তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমি যখন টুটিয়াও প্রতিষ্ঠা করি এবং কর্মী নিয়োগ দেই, তখন এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল। ২০০৯ সালে ঝ্যাং তার প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। এটি ছিল ৯৯ফ্যাং ডটকম নামে একটি সম্পত্তি অনুসন্ধান বিষয়ক ওয়েবসাইট। তিন বছর পরেই এ ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু ঝ্যাংয়ের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিল এই কোম্পানিটি। ২০১২ সালে বাইটড্যান্স প্রতিষ্ঠা করেন ঝ্যাং ইমিং। এটি সেসময় কেবল সংবাদ একত্রিতকরণ সংক্রান্ত সেবা দিতো। ঝ্যাং বুঝতে পেরেছিলেন, চীনে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা মোবাইল অ্যাপে প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে পেতে ঝামেলায় পড়ছেন এবং সার্চ ইঞ্জিন বাইদু অনুসন্ধানের ফলাফলের সঙ্গে অপ্রকাশিত বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। এসব সমস্যা এড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ব্যবহারকারীদের কাছে প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু উপস্থাপনে ঝ্যাংয়ের আগ্রহই শেষপর্যন্ত বাইটড্যান্সের জন্ম দেয়। বেইজিংয়ে চার বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে যাত্রা শুরু করেছিল কোম্পানিটি। এর কর্মীরা সেসময় ওই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকতেন এবং কাজ করতেন। এ বিষয়ে ঝ্যাং একটি স্লোগানের কথা উল্লেখ করেন, যা তিনি কোনো একটি নির্মাণ সাইটে দেখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘ছোট জায়গা, বড় স্বপ্ন’। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ঘরটি ছিল ১০ বর্গমিটারের মতো। কিন্তু আমাদের আইডিয়া ছিল অনেক বড়। আমরা একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বিশ্বায়ন সম্পর্কে কথা বলতাম। কোম্পানি নিয়ে বেশিরভাগ উদ্যোক্তার মতো ঝ্যাংয়ের পরিকল্পনা কেবল চীনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সারা বিশ্বে বাইটড্যান্সকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই দৃষ্টিভঙ্গি সেসময় বিনিয়োগকারীদের মন জয় করতে পারেনি। একাধিকবার চেষ্টা করেও তিনি প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে ব্যর্থ হন। তবে হাল ছাড়েননি। শেষমেষ প্রকল্পের সম্ভাবনা দেখে স্টার্টআপটিতে বিনিয়োগ করতে রাজি জয় সুসকেহান্না ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ। ২০১২ সালের আগস্টে টুটিয়াও নিউজ অ্যাপ চালু করে বাইটড্যান্স। দুই বছরের মধ্যেই ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি দৈনিক ব্যবহারকারী পেয়ে যায় তারা। অ্যাপটির কার্যক্রম সম্পর্কে ঝ্যাং বলেন, আমরা তথ্য ঠেলে দেই। তবে প্রশ্ন করে নয়, সংবাদ সুপারিশের মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা সংবাদ ব্যবসায়ী নই। আমাদেরটি একটি অনুসন্ধান ব্যবসা বা একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মতো। ঝ্যাংয়ের নেতৃত্বে বাইটড্যান্সের ব্যবস্থাপনা স্টাইল তৈরি হয়েছিল মার্কিন টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট ও গুগলের মতো করে। এতে দ্বি-মাসিক বৈঠকের ব্যবস্থা যেমন ছিল; তেমনি চীনা রীতি অনুসারে, শীর্ষকর্তাকে ‘বস’ বা ‘সিইও’ হিসেবে উল্লেখ করা থেকে কর্মচারীদের নিরুৎসাহিতও করা হতো।টিকটকের উত্থান ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষুদ্র ভিডিও-শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক (চীনে ডুয়োইন নামে পরিচিত) চালু করে বাইটড্যান্স। তখন এর ফ্যানবেজ ছিল একেবারেই ছোট। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তরুণ প্রজন্মের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অ্যাপটি এবং ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এর খ্যাতি। কিছুদিন পরেই প্রায় ৮০ কোটি মার্কিন ডলারে আরেকটি চীনা সোশ্যাল মিডিয়া মিউজিক্যাল ডট লি কিনে নেয় বাইটড্যান্স এবং সেটিকে টিকটকের সঙ্গে একীভূত করা হয়। রয়টার্সের তথ্যমতে, গত বছর বাইটড্যান্সের মূল্য ৪০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। এ বছরের অক্টোবরে তা কমে ৩০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। চার রুমের অ্যাপার্টমেন্টে যাত্রা শুরু করা কোম্পানিটিতে গতকাল বুধবার বিশ্বব্যাপী কর্মী রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজারের মতো। এরইমধ্যে ১০০ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক পার করেছে টিকটক।
টিকটকের ভবিষ্যৎ : অ্যাপটিতে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ঝ্যাং বলেন, বহুদিন ধরে আমি নিজে কিছু না বানিয়ে শুধু টিকটকের ভিডিও দেখছিলাম। কারণ এটি মূলত তরুণদের জন্য তৈরি। কিন্তু পরে ব্যবস্থাপনা টিমের সব সদস্যের জন্যই ব্যক্তিগতভাবে টিকটক ভিডিও বানানো বাধ্যতামূলক করে দেই। তাদের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘লাইক’ পেতে হবে। নাহলে ‘পুশ-আপ’ দিতে হবে। এটা আমার জন্য অনেক বড় একটি পদক্ষেপ ছিল। এই পদক্ষেপটি ঝ্যাংকে নিজের ও কর্মীদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে টিকটককে কীভাবে আরও নিখুঁত করা যায়, তা বুঝতে সাহায্য করেছিল। কর্মচারীদের মতে, ঝ্যাং ইমিংয়ের নেতৃত্বের স্টাইল হলো ‘মৃদুভাষী অথচ ক্যারিশম্যাটিক, যৌক্তিক অথচ আবেগপ্রবণ, তরুণ অথচ জ্ঞানী’। অ্যাপটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন, আমি চাই টিকটক বিদেশেও ছড়াতে থাকুক। আশা করি, বাইটড্যান্স একদিন গুগলের মতো ‘সীমাহীন’ হবে। ২০২১ সালের মে মাসে বাইটড্যান্সের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান ঝ্যাং। একই বছরের নভেম্বরে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও পদত্যাগ করেন তিনি। শোনা যায়, চীনা সরকারের চাপেই নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নেতৃত্ব ছাড়তে হয়েছে তাকে। তবে এরইমধ্যে নিজ যোগ্যতায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ঝ্যাং ইমিং। ফোর্বসের হিসাবে, এই মুহূর্তে তার সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার। ২০১৩ সালে প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকীটির ‘চায়না ৩০ আন্ডার ৩০’ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris