বৃহস্পতিবার

২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নওগাঁ হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট রোগী বাড়লেও বাড়েনি সেবার মান

Paris
Update : বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০২২

সুমন আলী, নওগাঁ
চিকিৎসক সংকটে নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। ৪৫ জনের মধ্যে মাত্র ৩২ চিকিৎসক দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে।
নওগাঁ জেলায় প্রায় ২৮ লাখ মানুষের বসবাস। জেলায় বসবাসরত মানুষের একমাত্র ভরাসাস্থল নওগাঁ সদর হাসপাতাল। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ১৬শ জন ও ইনডোরে আরও তিন শতাধিক রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। জেলা ছাড়াও পাশের বগুড়া জেলার আদমদীঘি ও জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকেও লোকজন আসে এ হাসপাতালে সেবা নিতে। কিন্তু আশানূরুপ সেবা না পাওয়ায় সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।
এদিকে, জেলার মানুষকে উন্নত সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটি। তবে আগের ১০০ শয্যা হাসাপাতালের যে জনবল সেটা দিয়েই ২৫০ শয্যার কার্যক্রম চলছে। এতে করে রোগীদের চাপে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা। উন্নত চিকিৎসা সেবাও থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নওগাঁর মানুষ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১০০ শয্যার হাসপাতালে উপ-পরিচালক, শিশু, মেডিসিন, সার্জারি, ফরেনসিক, চক্ষু, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজি ইমেজিং, কার্ডিওলজি, চর্ম ও যৌন, গাইনি অ্যান্ড অবস, নাক-কান-গলা, প্যাথলজি, নিউরোসার্জারি, নেফ্রোলজি, ও মেডিকেল অফিসারসহ মোট ৪৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে আছে মাত্র ৩২ জন। নার্স ৮৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ৭৮ জন। বর্তমানে ১৩ জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে আউটডোর ও ইনডোরে সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ১৬০০ এবং ইনডোরে প্রায় ৩ শতাধিক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
এছাড়াও ১০০ শয্যার জন্য মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, চক্ষু, অর্থোপেডিকস ও রেডিওলজি ইমেজিং, জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি অ্যান্ড অবস, মানসিক, প্যাথলজি ও নেফ্রোলজি, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার চক্ষু, রেডিওলজিস্ট এবং ইনডোর মেডিকেল অফিসার কার্ডিওলজি ও মেডিসিন প্রতি পদে একটি করে শূন্য রয়েছে। এছাড়া হাসপাতাল পরিচালনার জন্য ১৭৬টি মঞ্জুরি পদের বিপরীতে জনবল আছে ১২১ জন।
নওগাঁ সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, র্দীঘ লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অনেক সেবা প্রত্যাশীরা বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অনেকে বেড না পেয়ে মেঝে এমনকি বারান্দায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। অন্যদিকে রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালের দায়িত্বরতরা। অভিযোগ রয়েছে হাসপাতাল থেকে রোগীদের ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি বাড়তি ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।
ইনডোরে রোগী দেখার পর ডাক্তার আউটডোরে গিয়ে রোগী দেখা শুরু করেন। এতে হাসপাতালের আউটডোরে সেবা নিতে আসাদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার চিকিৎসক না থাকায় হয়রানির হতে হচ্ছে সেবা নিতে আসা রোগীদেরও।
জেলার নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে পায়ের চিকিৎসা করাতে এসেছেন রমজান আলী, কথা হলে রমজানের মেয়ে নিলুফা খাতুন বলেন, অর্থোপেডিক ডাক্তারের রুমের সামনে এতই ভিড় বাবাকে যে পাশে কোথাও বসিয়ে রাখবো সেই ব্যবস্থাও নেই। ২ঘন্টা অপেক্ষা করেও বাবাকে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি। অন্যকোন দিন আবার আসবো আর না হয় রাজশাহীতে নিয়ে যাবো।
একই অবস্থা মেডিসিন বিভাগের সামনেও, দীর্ঘ লাইনে প্রায় ৫০-৬০জনের মত সেবাপ্রত্যাশীরা দাঁড়িয়ে আছেন। আমেনা বেগম নামের এক সেবা প্রত্যাশী বলেন, দুইদিন হলো ঘুরে গেলাম। সেই সকাল ১০টায় এসেছি ১২টা বেজে গেল কিন্তু এখনও ডাক্তারের কাছে যেতইে পারলামনা। অনেকে বাধ্য হয়ে ফিরে গেছে। আমি চলে যাবো। আর কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আরো অসুস্থ্য হয়ে যাবো। একসাথে তিন -চারটি রুমে যদি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রোগি দেখতো তাহলে এত ভোগান্তি পোহাতে হতোনা।
হাসপাতালের নতুন ভবনের সার্জারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে মেঝেতে ও বাড়ান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। কামরুল হোসেন নামের একজন বলেন, আমার ভাইকে ভর্তি করা হয়েছে। বেড সংকট তাই মেঝেতেই চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে। কি আর করার বাধ্য হয়েই এসেছি সরকারি হাসপাতালে।
রেনুকা বেগম নামের এক রোগী বলেন, বেড নাই তাই বারান্দায় থেকেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। সুচিকিৎসা পাওয়াতো আমাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু চিকিৎসাটাও ভালো ভাবে পাইনা আমরা। বারান্দায় এভাবে থাকা যে কতটা কষ্টের তা বুঝাবো কি করে ? টাকা খরচ করে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করার মত সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়েই এখানে থেকেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর থেকে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে মিলাদুল ইসলাম এসে ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। এসময় তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আর বেশি ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।
নওগাঁ নাগরিক কমিটির সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট এ.কে.এম ফজলে রাব্বী বকু বলেন, ২৮ লাখ মানুষের ভরসা নওগাঁ সদর হাসপাতাল। চিকিৎসক সংকটের কারনে যদি কেউ সময়মত সেবা না নিতে পারে তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক কি আর হতে পারে। হাসপাতালে যদি সেবার মান ভালো না হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে সেবা নিতে। চিকিৎসক সংকটসহ হাসপাতালের সার্বিক সমস্যা দূর করে যেন সেবার মান বৃদ্ধি করা হয় সেই দাবি জানাচ্ছি।
নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ২৫০ শয্যা বলা হলেও ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে যে পরিমাণ জনবল দরকার তাও এখানে নেই। এতে করে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ১৬০০ জন ও ইনডোরে প্রায় তিন শতাধিক রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় থেকে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেবার মান বৃদ্ধির জন্য চাহিদাপত্রের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি চাহিদাগুলোর অনুমোদন পেলে ডাক্তার, সেবিকা, ঔষধ ও অবকাঠামোসহ সার্বিকভাবে সেবার মান আরও ভালো হবে বলে আশা করছি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris