শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বড় বড় প্রকল্পের জন্য বিপুল বিদেশী ঋণ নিয়েছে সরকার

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

এফএনএস : সরকার বড় ড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিপুল বিদেশী ঋণ নিয়েছে। বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় ও দাতা সংস্থার ঋণ, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট ও লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ওসব ঋণ বাড়ছে। ফলে ওই ঋণ পরিশোধে ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বার্ষিক নিট বিদেশী ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার বার্ষিক নিট বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রাক্কলন রয়েছে। গত অর্থবছরেও এর পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৪১০ কোটি। মূলত মেগা প্রকল্পগুলোতেই সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ ব্যবহার হয়।

বর্তমানে দেশে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আর প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ায় প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বিদেশী ঋণের পরিমাণও। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নিট বিদেশী ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮-অর্থবছরে ২৫ হাজার ৬২০ কোটি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা বিদেশী ঋণ নেয়া হয়। আর চলতি অর্থবছরের বাজেটে তার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এই সময়ের ঋণ পরিশোধে ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণও বেড়েছে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরেও বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকায়। তবে বিদেশী ঋণ মাত্রা ছাড়ালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর চাপ পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়ছে। আর তার সঙ্গে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও। বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ করতে গিয়ে ভবিষ্যতে ওই চাহিদা মারাত্মক চাপে রূপ নেয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। শ্রীলংকায় চলমান ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকটের মূলেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ। বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদের বোঝা টানতে গিয়েই দেশটির রিজার্ভে চাপ পড়েছে।

সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটিই হচ্ছে টাকার অংকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি করতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তার মধ্যে রাশিয়া ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। বাকি টাকার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। তাছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। চীনের ঋণে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণ ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।

তার মধ্যে চীনের ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর যানজট কমাতে ঢাকায় তৈরি হচ্ছে ৬টি মেট্রোরেল লাইন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রথম লাইনটি (এমআরটি লাইন-৬) তৈরিতে ঋণ দিচ্ছে জাইকা। লাইনটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাইকার ঋণ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ডুয়াল গেজ রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে এডিবির ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

তাছাড়া জাইকার ঋণে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে রেলওয়ের জন্য আলাদা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রেলসেতুটি তৈরি করতে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। তার মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এডিবির ঋণে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়কটি ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনসহ চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। সড়কটি তৈরি করতে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। তার মধ্যে ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। কিন্তু দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই প্রায়ই সেগুলোর নির্মাণকাজে ধীরগতি দেখা যায়। তাতে জনভোগান্তির পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয়ও। যা বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

সূত্র আরো জানায়, দেশের রাজস্ব আহরণ ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর ওই ঘাটতি পূরণেই বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ঋণের অর্থ পরিশোধে কোনো দুর্নাম না থাকায় আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারীদের কাছেও ঋণগ্রহীতা হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৪১৮ কোটি ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পেয়েছিল। ওই হিসেবে আগের অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় এবার একই সময়ে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ।

এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের অর্থনীতি যত বড় হতে থাকবে ততই দক্ষতার প্রয়োজনও বাড়বে। সেক্ষেত্রে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প শেষ করাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প সাশ্রয়ী করা, সময়মতো শেষ করা ও সুশাসনের সঙ্গে সম্পন্ন করার বিষয়ে অভাব থাকলে ঝুঁকি তৈরি করে। কারণ সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প করতে না পারলে বেশি খরচের কারণে সেবার ব্যয়ও বাড়বে। আবার সময়মতো না করার ফলে ঋণ পরিশোধ ও প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুফলের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড ও সক্ষমতা ভালো। বিদেশী ঋণ ও জিডিপি অনুপাত এখনো কম। মাত্র ১৩ শতাংশের মতো।

তবে বাংলাদেশকে এখনই সাবধান ও সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটায় সুদের পরিমাণও বাড়ছে। বিষয়গুলোকে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার খাত ঠিক করতে না পারলে বা প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে ওসব অবকাঠামো থেকে ভবিষ্যতে আয়ও কমে যাবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিবির কাছ থেকে সরকার সর্বোচ্চ ১৭২ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮২ কোটি ডলার ছাড় করেছে জাইকা। তৃতীয় স্থানে আছে চীন। দেশটি ছাড় করেছে ৪৩ কোটি ডলার। এডিবি থেকে পাওয়া ঋণ দিয়ে দেশে টিকা কিনে আনা হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। চীনের অর্থায়নেও বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রচুর ঋণসহায়তা রয়েছে।

অন্যদিকে বিপুল বিদেশী ঋণ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। তাছাড়া ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই। তাই গত দুই অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাছাড়া দেশের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে করোনার টিকা ক্রয়েও বিদেশী অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাই বিদেশী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এখন যে পরিমাণ ঋণ দাঁড়িয়েছে, তাতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহাম্মদ জানান, দেশে প্রকল্প সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। এখন প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি। ওগুলো পাইপলাইনে আছে। এখন পর্যন্ত নেয়াই যায়নি। বাংলাদেশ এখন বিদেশী সাহায্যনির্ভর নয়। বাংলাদেশ এখন আমরা ঋণ নিচ্ছে। আগে ছোট আকারের প্রকল্প থাকায় ঋণও ছিল কম। এখন প্রকল্প বড় হওয়ায় ঋণের আকারও বড়। ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ যেমন বাড়বে আবার লভ্যাংশও বাড়বে। দিন শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি হবে।

আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুবিধা যেন সবার কাছে পৌঁছায় সরকার তার ব্যবস্থাও নিচ্ছে। ঋণ যখন বেশি তখন তার সুফলও বেশি। চলমান সব মেগা প্রকল্পের সুফলও অনেক বেশি। তবে এ বিষয়ে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সরকার এ বিষয়ে নিষ্ঠাবান। বর্তমানে সমস্যার মধ্যে পড়েছে এমন কোনো দেশের মতো অবস্থা বাংলাদেশের যেন না হয় সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris