শনিবার

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
তীব্র তাপদাহে রাজশাহীতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগী তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে প্রাইমারি স্কুলে অ্যাসেম্বলি না করানোর নির্দেশ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্ত মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে : জাতিসংঘ রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত রাজশাহীতে বাংলাদেশ কৃষক লীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত ধামুইরহাটে ভূয়া সিআইডি গ্রেফতার রাজশাহীতে বিভাগীয় পেনশন মেলা অনুষ্ঠিত স্ত্রীকে কারাদণ্ড দেওয়া নিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ইমরান খানের হুমকি ইরানের ইসফাহান কেন হামলার টার্গেট?

বিএমডিএ’র অপারেটরদের দৌরাত্ম্য

Paris
Update : বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০২২

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় বোরো ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই কৃষক কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়োগকৃত অপারেটর জমিতে চাহিদামতো পানি না দেওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন দুই কৃষক। অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) ও তাঁর চাচাত ভাই রবি মারান্ডির (২৭) এমন আত্মত্যাগের ঘটনা দেশের ইতিহাসেও প্রথম বলে দাবি করেছেন কৃষকরা।

রাজশাহীর কৃষকদের দাবি, বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ অপারেটররা প্রতটি উপজেলায় কৃষকদের জিম্মি করে বোরো ধান চাষ করার জন্য বিঘাপ্রতি দেড়-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে চলেছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই হাজার টাকার ওপরে আদায় করা হচ্ছে। আর কৃষকদেরকে সেই টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। না হলেই জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন অপারেটরা। ফলে জমির ধান বাঁচাতে ধার-দেনা করে হলেও টাকা তুলে দিচ্ছেন অপারেটরদের হাতে। আবার গভীর নলকূপ চালানোর জন্য প্রিপেইড মিটারে কার্ড কিনে জমিতে পানি সেচ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কার্ডের মাধ্যমেও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে কৃষকদের। ফলে ধানচাষ করতে গিয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়েছেন রাজশাহীর কৃষকরা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক বিঘা জমিতে ধানচাষ করতে গিয়ে বিঘা প্রতি ২৫শ’ থেকে তিন হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে কৃষকদের। যা দুই-তিন বছর আগেও ছিল বড়ো জোর দেড় হাজার টাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকরা চুক্তি অনুযায়ী বিঘাপ্রতি টাকা দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো গভীর নলকূপের অপারেটররা কৃষকদেরকে দিয়েই প্রিপেইড মিটারের কার্ড কিনে আনতে বাধ্য করছেন। সেই কার্ড দিয়ে ঘন্টাপ্রতি ২৮০-৩০০ টাকা পর্যন্ত কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে গিয়ে বিঘা প্রতি কৃষকদের অন্তত ৩ হাজার টাকার খরচ হচ্ছে। তবে যাদের নিচু জমি, পানির প্রয়োজন কম হয়, তাদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২৫শ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে।

গোদাগাড়ীর ঈশ্বরীপুর এলাকার কৃষক আমির হাঁসদা বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে ধানের জমিতে পানি সেঁচ করতে এবার তিন হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে দাদা। এই টাকা আমরা অনেক কৃষক দিতে পাচ্ছি না এখুন। ধানের জমিতে সার-বিষও দিতে হচ্ছে। এখুন এতো টাকা পাব কুণ্ঠে। যারা টাকা দিতে পাচ্ছে না, তার জমিতেই পানি দেয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘টাকা দিলেও আমাদের মুতোন গরিব মানুষের জমিতে সহজে পানি দেয় না। ওপারেটর (গভীর নলক’পের অপারেটর) তার নিজের লোকদের আগে পানি দেয়। অপারেটর সাখাওয়াত তার ইচ্ছেমতো পানি দেন জমিতে। আর জমিতে পানি না পায়ে আত্মহত্যার করেন অভিনাথ ও রবি। এটা দ্যাশের প্রথম ঘটনা দাদা। এই ঘটনার আমরা বিচার চাই।’ তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অপারেটর সাখাওয়াত পলাতক থাকায় এবং তাঁর ফোন বন্ধ থাকায় তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে তানোরের কৃষ্ণপুর এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকার সব ডিউবওয়েলেই (গভীর নলক’পের) অপারেটরই দুই থেকে তিন হাজার টাকা নিচ্ছে। টাকা কয়েক কিস্তিতে আদায় করা হচ্ছে। ধান ওঠার আগেই টাকা দিতে গিয়ে আমরা কৃষকরা বিপাকে পড়ছি।’ একই এলাকার কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, ‘ধানের জমিতে পানি স্যাঁচ দিতে অনেকেই ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ সুদের ওপরে টাকা নিয়েও অপারেটরের হাতে তুলে দিচ্ছে জমির ধান বাঁচাতে।’ জানতে চাইলে কৃষ্ণপুর এলাকার অপরেটর আব্দুল গনি দাবি করেন, বিঘাপ্রতি ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

এই টাকার অল্পকিছু লাভ থাকে। এর বাইরে বাকিটা চলে যায় বিদ্যুৎ খরচে। তাই কারও নিকট অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে না।’ রাজশাহীর দুর্গাপুরের নওপাড়া এলাকার কৃষক মাজেদুর রহমান বলেন, ‘সবগুলো ডিপেই (গভীর নলকূপ) বিঘায় দুই হাজার থেকে ২২শ টাকা করে নিচ্ছে। যা গত বারও আছিল সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা। এতে ধান চাষ করতে গিয়ে এবার বাড়তি খরচও হচ্ছে।’

এদিকে বিএমডিএ’র গভীল নলকূপের অপারেটররা ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিব। প্রয়োজনে অপারেটরের নিয়োগ বাতিল করে নতুন অপারেটর দেওয়া হবে। তবে কৃষকদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করতে দেওয়া হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন খরা মৌসুমের কারণে হয়তো হয়তো চাহিদামতো কোনো কোনো জায়গায় পানি দেওয়া যাচ্ছে না। তবে তাতে ধানের তেমন কোনো ক্ষতি হয়েছে বলেও আমাদের কাছে খবর আসেনি।’

মান্দা প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দায় ব্যক্তি মালিকানার একটি গভীর নলকুপের অপারেটরের বিরুদ্ধে গলাকাটা সেচভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। কৃষকদের অভিযোগ, উপজেলা সেচ কমিটির বেঁধে দেওয়া ভাড়া আদায়ের নির্দেশনা মানছেন না অপারেটর। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনায় উপজেলা বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী ও ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী এক কৃষক।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শালদহ মধ্যপাড়া গ্রামে ‘ক্ষেতমজুর সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে একটি সংগঠন বোরো ধানের জমিতে সেচকাজের জন্য গভীর নলকুপ স্থাপন করে। এ সমিতির সভাপতি, ক্যাশিয়ার ও অপারেটরের নেতৃত্বে এটি পরিচালনা করা হয়। চলতি মৌসুমে একবিঘা জমিতে সেচের জন্য কৃষকদের নিকট থেকে আদয় করা হচ্ছে ৩৫০০ টাকা করে। এর প্রতিবাদ করেও কোনো প্রতিকার পাননি কৃষকেরা। উপজেলা বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, উপজেলা সেচ কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে চলতি মৌসুমে এ দপ্তরের অধীনে গভীর নলকুপে অঞ্চল ভেদে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।

ব্যক্তি মালিকানার ক্ষেত্রে প্রতি বিঘায় সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা ভাড়া আদায় করা যাবে। কোনোভাবেই এর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার সুযোগ নেই। শালদহ গ্রামের কৃষক রবিন্দ্রনাথ প্রামানিক বলেন, ওই গভীর নলকুপ থেকে পানি নিয়ে এবারে সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। প্রতি বিঘার জন্য ভাড়া গুনতে হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। একটুও কম দিতে পারিনি। প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি বলে জানান তিনি। একই ধরণের অভিযোগ করেন শালদহ গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক, আমিনুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, কার্তিক চন্দ্র হালদারসহ আরও অনেকে।

অভিযোগকারী কৃষক বিমান চন্দ্র প্রামানিক বলেন, গভীর নলকুপের সভাপতি কামাল হোসেন ওরফে কামরুলের নেতৃত্বে কৃষকের কাছ থেকে গলাকাটা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া অন্তত ৬০ বিঘা খাস জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদ ও ভোগদখল করেছেন সমিতির সদস্যরা।

তিনি আরও বলেন, কোনো কৃষক এসবের প্রতিবাদ করলে তাঁদের জমিতে পানি সেচ দেওয়া হয় না। তাই প্রতিকার পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বাক্কার সিদ্দিক ও বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। শালদহ ক্ষেতমজুর সমবায় সমিতির সভাপতি কামাল হোসেন কামরুল বলেন, গভীর নলকুপে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এজন্য প্রতি বিঘায় ৩৫০০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। উপজেলা বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী ও উপজেলা সেচ কমিটির সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন অভিযোগ প্রাপ্তির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনাস্থলে একটি তদন্ত টিম পাঠানো হবে।

অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা সেখানে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বাক্কার সিদ্দিক বলেন, সেচ কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris