শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নওগাঁয় যৌতুকের দাবিতে চুল কর্তন, ১ মাসেও আদালতের নির্দেশনা আসেনি থানায়

Paris
Update : বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০২২

সুমন আলী, নওগাঁ : যৌতুকের দাবিকৃত চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় গৃহবধূর মাথার চুল কেটে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। নির্যাতনের বিচার চেয়ে স্থানীয় থানার দারস্থ হলেও থানা পুলিশ মামলা না নেয়ায় নিরুপায় হয়ে নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল আদালত-১ এ মামলা দায়ের করেন নির্যাতিত গৃহবধূ। মামলা করার প্রায় ১ মাস হয়ে গেলেও কোন বিচার না পাওয়ায় অসহায়বোধ করছেন ভুক্তভোগী গৃহবধু ও তার দিনমজুর পরিবার। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, আদালত থেকে মামলার বিষয়ে থানায় কোন নির্দেশনা আসেনি বা ওই গৃহবধূ থানায় কোন অভিযোগও করেনি।

আদালতে মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারী নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মধুপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামের ছেলে ফিরোজ হোসেন এর সাথে বিয়ে হয় পাশ্ববর্তী ভান্ডারপুর দিঘীরপাড় গ্রামের হোসেন আলীর মেয়ে হাছিনা বেগম (২৬) এর। বিয়ের দিন জামাইকে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসা করার জন্য ১ লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে দেয় হাসিনার বাবা। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ফিরোজ হোসেন আরো ১ লাখ টাকা এনে দেয়ার জন্য তার স্ত্রী হাছিনা বেগমকে থাকে। হাসিনা দাবি মেনে না নেওয়ায় স্বামী ও স্বামীর পরিবারের লোকজন তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে নানা সময়।

তবুও নির্যাতন সহ্য করে ঘর সংসার করে আসছিল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারী স্বামী ফিরোজ হোসেন, তার মামা ফজলু হোসেন এবং খালা শেফালী বেগম এর প্ররোচনায় তাদের সাথে নিয়ে আবার যৌতুকের ১ লাখ টাকা এনে দেয়ার জন্য হাছিনা বেগমকে চাপ প্রয়োগ করে। এসময় হাছিনা বেগম আকুতি নিয়ে বলেন, আমার বাবা দিনমজুর এত টাকা দেয়ার সমার্থ্য নেই। কথা বলার এক পর্যায়ে বেল্ট দিয়ে হাছিনার সারা শরীরে এলোপাতারী মারপিট করতে থাকে ফিরোজ। এ সময় হাছিনা চিৎকার করতে থাকলে তারা মুখে কাপড় দিয়ে আবারো নির্যাতন করতে থাকে হাছিনাকে।

নির্যাতনের এক পর্যায়ে হাছিনা অজ্ঞান হয়ে পড়লে স্বামী ফিরোজ হোসেনের মামা ও খালার নির্দেশে হাছিনার মাথার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলা হয়। হাছিনার উপর চলা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে হাছিনার জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। ঘটনার পরদিন ২৩ফেব্রুয়ারী সকালে গৃহবধু হাছিনা বেগম রানীনগর থানায় মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ মামলা বা অভিযোগ নেয়নি। পরে নিরুপায় হয়ে নির্যাতিত গৃহবধু ২৮ ফেব্রুয়ারী নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল আদালত-১ এ মামলা দায়ের করেন। (মামলা নম্বর ৮৫/২০২২)

গৃহবধুর বাবা হোসেন আলী বলেন, আমি একজন দিনমজুর। অনেক কষ্টে করে মেয়েকে বিয়ে ও জামাইয়ের চাহিদামত যৌতুক দিয়েছিলাম। জামাইয়ের পরিবারের চাহিদামত যা পেরেছি নানা সময় সাধ্যমত দিয়েছি। তবুও বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আমার মেয়েটাকে আবারো যৌতুকের জন্য চাপ ও নিযার্তন করে আসছিল। তবুও মেয়েটা সহ্য করে সংসার করছিল। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারী জামাই ফিরোজ হোসেন, তার মামা ফজলু হোসেন এবং খালা শেফালী বেগম আমার মেয়ে অনেক নির্যাতন করে যৌতুকের জন্য। তার পর বাড়ি থেকে বের করে দেয় মেয়েটাকে। থানায় গেলে পুলিশ মামলা বা অভিযোগ নেয়নি। তাই আদালতে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আদালত থেকে তদন্ত করার জন্য রিপোর্ট বা আসামীদের গ্রেফতারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। এত দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সুষ্ট বিচার পাচ্ছিনা আমরা।

নির্যাতনের স্বীকার গৃহবধু হাছিনা বেগম বলেন, একজন নারী অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে যায় বাঁকি জীবনটুকু একটু সুখের আশায় ঘর,সংসার ও সন্তান নিয়ে কাটিয়ে দিতে। আমার বাবা সাধ্যমত আমার স্বামীর চাহিদা পূরণ করেছে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বুঝতে পারলাম স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন যৌতুক লোভী। নানা সময় আরও টাকা দাবি করে আসছিল। টাকা দিতে না পারায় গত কয়েক বছরে কতবার যে স্বামীর নির্যাতন এর স্বীকার হয়েছি তার বলা মুসকিল। তবুও সংসার করবো বলে নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর বাড়িতে ছিলাম। সর্বশেষ গত ২২শে ফেব্রুয়ারী আমার স্বামীসহ তার মামা ফজলু এবং খালা শেফালী’র প্ররোচনায় বেল্ট দিয়ে আমার সারা শরীরে মারপিট করে।

আমি চিৎকার করতে থাকলে তারা মুখে কাপড় গুজে দিয়ে আবারো নির্যাতন করতে তাকে। নির্যাতনের এক পর্যায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়লে স্বামীসহ মামা ও খালার নির্দেশে আমার মাথার চুল কাচি দিয়ে সমুদয় কেটে ফেলে। আবার মাথার কোথাও কোথাও প্রায় নেড়ে করে দেয়া হয়। এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। তার একদিন পর থানায় এ বিষয়ে আমিসহ পরিবারের লোকজন মালা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ কোন মামলা তো দূরের কথা সাধারন অভিযোগও নেয়নি। পরে বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করি।
হাছিনা আরো বলেন, মামলা দায়েরের এখন পর্যন্ত কোন বিচার পাইনি। আমার উপর চলা নির্যাতনের আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। দোষীদের এমন শাস্তি দেয়া হোক যাতে আর কোন স্বামী যেন যৌতুকের জন্য তাদের স্ত্রীদের নির্যাতন করার সাহস না পায়। যদি সঠিক বিচার না করা হয় তাহলে যৌতুক লোভীরা তাদের স্ত্রীদের নির্যাতন করতে উৎসাহিত হবে। দেশের অনেক গৃহবধু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে।

রাণীনগর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম কচি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল আদালতে মামলা হলে অনেক সময় আমাদের মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশনা দেয়া হয় আদলত থেকে। তবে মধুপুর গ্রামে নির্যাতনের স্বীকার গৃহবধু হাছিনা বেগম এর দায়ের করা মামলার বিষয়ে কোন নির্দেশনা আমি এখনও পাইনি। নিদের্শনা পেলে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিবো। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে রাণীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.শাহিন আকন্দ বলেন, ওই গৃহবধুসহ পরিবারের কেউ এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ নিয়ে আসে নাই। তারা যদি থানায় অভিযোগ নিয়ে আসতো তা হলে অবশ্যই ব্যাবস্থা নেওয়া হতো।

আর আদালতে মামলা করেছেন এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। আদালত থেকে কোন নির্দেশনা বা তদন্ত করার জন্য কোন চিঠিও পাইনি আমরা। নির্যাতন এর স্বীকার গৃহবধু থানায় এসেছিল ২৩শে ফেব্রুয়ারী, তাদের অভিযোগ থানা পুলিশ অভিযোগ বা মামলা নেয়নি। তবে কি তারা মিথ্যা বলছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি শাহিন বলেন, দেখুন আমি তো বললাম, তারা যে এসেছিল এমন কোন তথ্য আমার জানা নেই। এখন আদালতে যেহেতু মামলা করেছেন সেক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী আমরা পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris