শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

যুগের চাহিদার সাথে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও!

Paris
Update : রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : মানুষের জীবন সংকীর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই সংকীর্ন জীবনটাই কারও কারও কাছে দীর্ঘ হয়ে উঠছে, হয়ে উঠছে বোঝা। আর তাই মূল্যবান জীবনটাকে তারা সহজেই অপচয় করে ফেলছে আত্মহত্যার পমানুষের জীবন সংকীর্ণ। আর তাই মূল্যবান জীবনটাকে তারা সহজেই অপচয় করে ফেলছে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়ার মাধ্যমে।

দেশে আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকারি উৎস তথ্যের সংকট থাকলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে ভয়ানকভাবে। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী ৩৫ শতাংশ আত্মহত্যার কারণ পারিবারিক সমস্যা। এ কারণে যাঁরা আত্মহননের পথ বেছে নেন তাঁরা তুলনামূলক বয়স্ক। সম্প্রতি এর জ¦লন্ত নজির পাওয়া গেলো। চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খান আত্মহত্যা করলেন। তাঁর বয়স ছিল ৫৮ বছর। তবে শুধু বয়স্ক নয় তরুণ ও যুবকদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, অন্যতম একটি কারণ হলো মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। চাপটা বেশি হয়ে গেলে কারো কারো মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়। এ ছাড়া যৌতুক, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, হতাশা, অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বিষণ্ণতায় যারা ভোগেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে বেশি। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। ছেলেবেলা থেকে যারা নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন করে, এবং যে সমস্ত তরুণ-তরুণী শৈশবকালে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনাকালে একটি জরিপ করেছিল আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা গেছে, ওই সময় দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। তারা এই তথ্যগুলো নিয়েছে তিনটি জাতীয় দৈনিক, পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে তারা বলেছে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সম্পর্কজনিত কারণে।

আর্থিক কারণে আত্মহত্যার পরিমাণ ৪ শতাংশ। ১ শতাংশ আত্মহত্যা ঘটে লেখাপড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারণে। এবং সর্বশেষ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করে ৩২ শতাংশ। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে আঁচলের জরিপে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিদ্যমান। তবে সেখানে তরুণ-তরুণীরাই এগিয়ে বেশি। দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা, যা মোট আত্মহত্যার ৪৯ শতাংশ। এর পরই বেশি আত্মহত্যা করেছে পাঁচ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা, যা ৩৫ শতাংশ। ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ছিল ১১ শতাংশ। আর ৫ শতাংশের বয়স ছিল ৪৬ থেকে ৮০ বছর।

বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে চিত্র ভিন্ন। এখানে নারী বেশি আত্মহত্যা করে। নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, মূলত মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থেকেই বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দরকার নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আত্মহত্যার সাথে মৌসুম বা ঋতুর একটা গভীর সম্পর্ক আছে বলে জানা গেছে। মাসভিত্তিক আত্মহত্যা প্রবণতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে আত্মহত্যার হার বেশি।

ডিসেম্বর মাসে এই হার সবচেয়ে বেশি ছিল। এটা মোট ঘটনার ১৪.৮৫ শতাংশ বা ১৫ জন। সবচেয়ে কম ছিল এপ্রিল মাসে; ১.৯৮ শতাংশ বা দুজন। আত্মহত্যার প্রবণতা যুগ যুগ ধরেই পৃথিবীতে ছিল। কিন্তু অতীতে এই প্রবণতা ছিল অনেক কম। বর্তমানে এই প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এখন আর চুপিসারে নয়। ফেসবুক লাইভে এসে সবাইকে জানিয়ে আত্মহননের পথে যাচ্ছেন অনেকে। সর্বশেষ ফেসবুক লাইভে এসে চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সমাজবিজ্ঞানীদের। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম অণুঘটক হিসেবে কাজ করছে মানুষের অর্থলিপ্সা। ক্যারিয়ার আর অর্থের পেছনে ছুটছে মানুষ। এর ফলে গত কয়েক যুগে গতানুগতিক যৌথ পরিবার ভেঙে জন্ম হচ্ছে একক পরিবারের। এসব পরিবারের প্রবীণরা ভুগছেন একাকিত্বে। কখনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে, আবার কখনো পরিবারের অন্য সদস্যদের অবহেলায়। পুলিশ বলছে, দীর্ঘদিনের একাকী জীবন, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, ব্যবসায় লোকসানÑসব কিছু মিলিয়ে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে আবু মহসিন খান আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। শুধু তিনি নন, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় মাসে আরো তিনজন ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন।

জানা যায় গত বছরের ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায় সুমন নামের এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন। তাঁর এ মৃত্যুর জন্য তিনি কাউকে দায়ী করেননি। এ ছাড়া গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পুবাইলের স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর সবুজ সরকার নামে কুমিল্লার এক তরুণ সৌদি আরবে ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর বাইরেও প্রবীণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এঁদের বেশির ভাগই একা থাকেন অথবা পরিবারের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন। গত বছরের ৩ জানুয়ারি রাজধানীর লালবাগের নিউ পল্টন এলাকার নিজ বাড়ি থেকে জুলহাস মুন্সি (৭০) নামের এক বৃদ্ধের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, জুলহাস ওই বাসায় একাই থাকতেন। নিঃসঙ্গ অবস্থায় খালি ঘরে তিনি আত্মহত্যা করেন।

আত্মহত্যাকে প্রতিরোধ করতে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার অবশ্য অন্ত নেই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়াও বিভিন্ন বৈশ্বিক সংগঠন নানা প্রচার-প্রচারণা, ও কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আত্মহত্যার নেতিবাচকতা তুলে ধরার প্রয়াস চালায় প্রায়। ২০০৩ সাল থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসটি পালন করতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসাথে কাজ করে। ২০১১ সালে অনুমনিক ৪০টি দেশ এই দিবসটি উদযাপন করে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোন দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোন কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা নেই যেখানে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশসমূহের ১০% এবং উচ্চ আয়ের সব দেশেই এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris