বুধবার

২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
বাংলাদেশ-কাতার ১০ চুক্তি সই গোদাগাড়ীতে সাড়ে ৬ কেজি হেরোইনসহ মাদক ব্যবসায়ি এজাজুল হক ঝাবু গ্রেফতার রাজশাহীতে বৃষ্টির জন্য কোথাও ইসতিসকার নামাজ আদায় আবার কোথাও ব্যাঙের বিয়ে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে গোসলে নেমে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু রাজশাহীতে প্রতারণার ক্লু ধরে শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা আত্মসাত চক্রের মুল হোতসহ ৮ জন গ্রেফতার রাজশাহীর ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে এভারগ্রীণ’র দখল করে নির্মাণাধীণ কাউন্টার উচ্ছেদ করলো আরডিএ যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার করা হলে বিশ্ব রক্ষা পেতো : প্রধানমন্ত্রী শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানির তীব্র সংকট, ভোগান্তিতে রোগী-স্বজনরা নিয়ামতপুরে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড রাজশাহীতে নারীর মোবাইল ফোন-ব্যাগ ছিনতাই, তিন ছিনতাইকারী গ্রেফতার

বিপদ বলয়ে শিশু-কিশোররা

Paris
Update : মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষকরে কিশোর-কিশোরীদের কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নেশার মতো হয়ে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের এই আসক্তি নেশা জাতীয় দ্রব্যের আসক্তির চেয়েও ভয়াবহ। বাস্তব জীবনের সঙ্গীর চেয়েও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সৃষ্ট সঙ্গী বা বন্ধুই এখন অধিকাংশ মানুষের জীবনে প্রাধান্য লাভ করছে। কাছের মানুষদের সময় দেওয়ার সময় নেই। তাদেরকে বঞ্চিত করে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সময় ব্যয়িত হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যমে।

বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে এখন ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়েও বাংলাদেশের অগ্রগতি হচ্ছে দিনদিন। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ মিলিয়ন। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুগতিতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া অন্যতম দেশ হলো বাংলাদেশ। ১ হাজার ২৮১টি স্কুলে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বয়স ১১ বছরের নিচে। এই শিশুদের ১১ শতাংশ নিজেদের কক্ষে একান্তভাবে অনলাইন ব্যবহারে আগ্রহী এবং হাল জামানার ‘বেডরুম কালচার’-এর কারণে তারা অনলাইনে কী করছে বা দেখছে তা অভিভাবকদের পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই জরিপ অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের ৭০ শতাংশ ছেলে শিশু এবং ৪৪ শতাংশ মেয়ে শিশু স্বীকার করেছে, অনলাইনে তারা অপরিচিতদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, অপরিচিত বন্ধু তৈরির কারণে শিশু-কিশোরদের নানা ধরণের বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে। ইন্টারনেট সুবিধা তাদের কাছে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়েই দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন সতর্ক করেছিলেন, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যতের একটি প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল।

ওই প্রতিবেদনে জ্যাকবসন বলেছিলেন, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও। ইন্টারনেটে ঢুকলেই এখন সব ধরণের তথ্য পাওয়া যায় নিমিষেই। শিশু-কিশোররা এখন বইয়ের থেকে ইন্টারনেটকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। কোনো বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হলে ইন্টারনেট থেকে সহজেই এর সমাধান করে ফেলছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই তারা লাভবান হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকারান্তরে ওই ইন্টারনেটনির্ভরই হয়ে উঠছে।

আগে একসময় বই পড়া, পত্রিকা পড়া শিশু-কিশোরদের নিত্য রুটিন ছিল। এখন শিশুরাও সেটিতেই অভ্যস্ত ছিল। এখন সবারই সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক খবর বা তথ্যনির্ভরতা বাড়ছে। শিশুরাও একই প্রবণতায় নিমগ্ন হচ্ছে। এই ইন্টারনেটনির্ভর সমাজে চলছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। যে অপরাধটি বেশি ব্যাপকতা লাভ করেছে তা হলো সাইবার বুলিং। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কারও ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করাই হলো সাইবার বুলিং।

সূত্র জানায়, শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীরাও প্রতিনিয়ত এই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীরাই প্রথম দিকে এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছিল। এখন মধ্যবয়সীরাও এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন। সম্প্রতি সাইবার বুলিংকে এখন বিশ্বের বড় সমস্যা বলছেন আন্তর্জাতিক শিশু পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের নড়াইল জেলার সাদাত রহমান। ‘সাইবার বুলিং’ থেকে শিশুদের রক্ষায় কাজ করে ‘আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার’ পান নড়াইলের এই কিশোর। পুরস্কার গ্রহণের পর সাদাত বলেন, ‘সাইবার বুলিং কেবল বাংলাদেশ নয়; এটি এখন ইন্টারন্যাশনালি অনেক বড় সমস্যা।

সাইবার বুলিং নিয়ে সারাবিশ্ব এখন উদ্বিগ্ন। এ সমস্যা সমাধানে সারাবিশ্বকে আজ এগিয়ে আসতে হবে।’ করোনা মহামারীর কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। এখনো স্কুল-কলেজ পুরোদমে খুলেনি। স্কুল-কলেজের এই স্থবির অবস্থায় শিশু-কিশোররা এখন অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে করে অনলাইনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ায় ঝুঁকি বেড়েছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ইউরোপল। তারা জানিয়েছেন, শিশু-নিপীড়কদের সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। বাসায় শিশুরা একা একা ইন্টারনেট ঘাটছে বলে তাদের প্রতি অভিভাবকদের নজরও থাকছে কম। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের ফুসলানো নিপীড়কদের জন্য বেশ সহজ। শিশুরা যাতে উদ্বিগ্ন না থাকে সে বিষয়ে অভিভাবকদের লক্ষ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, নিয়মিত শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জানতে হবে অনলাইনে তারা সারাদিন কী করেছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। দেশের শতকরা ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী এবং ৭৩ শতাংশ নারীরাও সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন চতুর্থাশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তবে এ বিষয়টি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। মাত্র ২৬ শতাংশ অনলাইনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করে অভিযোগ দায়ের করেন। যদি বিষয়টি পারিবারিক গণ্ডির বাইরে চলে যায় তবে আইনের আশ্রয় নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশি ঝামেল এড়িয়ে চললেই বরং বিপদ। আর তা ভিকটিমকে বিপথেই পরিচালিত করবে। কিছু ধাপ অনুসরণ করলে এই কঠিন কাজই খুব সহজে হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা। তবে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা না নিয়ে একা একা থানায় যাওয়াটাও বোকামি। সঙ্গে রাখতে হবে হয়রানির প্রমান ও স্ক্রিন শর্ট কিংবা মেসেজ।

শুধু আমাদের দেশ নয়, ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর বয়সীদের মধ্যে একাকিত্বের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। তারা একা থাকছে এবং ডিজিটাল ডিভাইসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর হয়ে উঠছে। শিশু-কিশোরদের ভেতরে ইন্টারনেটভিত্তিক গেমস ও নানা ভিডিও দেখার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। গ্রাম পর্যায়েও শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক আর লাইকি নিয়ে উন্মাদনা বেড়েছে। বখাটেপনা ও নানা ধরনের অনৈতিক কাজও কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দমবন্ধ পরিবেশে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ।

এ ছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময় ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে আর ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ট্যাবে সময় ব্যয় করে। এই আসক্তির মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তা ব্যবহার করেছে অনলাইন ক্লাসের জন্য। আর ৪০ শতাংশ কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে, ২৭ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার এবং ১৭ শতাংশ আসক্ত বিভিন্ন গেমসে। এই গবেষণা প্রতিবেদন থেকেই কিছুটা অনুমান করা যায় যে শিশুরা ইন্টারনেট শুধু অনলাইন ক্লাস কিংবা পড়াশোনাতেই ব্যবহার করছে না, তারা ফেসবুক এবং গেমসের জন্যও ব্যবহার করছে।

জানা যায়, দেশে ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরি হয় এবং পরে এ আইন সংশোধন করা হয়। এ আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছে করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা বা অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলা ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। আধুনিক যুগে ইন্টারনেটকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু এই ইন্টারনেটে ব্যবহার যাতে শিশু-কিশোরদের ধ্বংসের কারণ না হয় সেজন্য সরকারের সজাগ থাকার কোন বিকল্প নেই। শিশু-কিশোরদের বিকাশকালে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবাইকে দায়িত্ব হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং প্রতিরোধে সরকারিভাবে নীতিমালা গ্রহণের পাশাপাশি শিশুদের সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris