বৃহস্পতিবার

১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধরাছোঁয়ার বাইরে মাদক কারবারিরা

Paris
Update : মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২২

এফএনএস : দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক।হরেক রকমের মাদকের নীল ছোবলে দেশের যুবসমাজের বড় একটি অংশ আজ জর্জরিত।কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও মাদক চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। মাদক কারবারিরা নানাভাবে থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে, কিন্তু সেসব মামলাও শেষমেশ আলোর মুখ দেখেনি। অবৈধ মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থপাচার) আইনে মামলা করতে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও কার্যক্রমে গতি নেই। গত ছয় বছরে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে এ আইনে ১৭টি মামলা করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর মধ্যে চারটি মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ সময় মোট ৪১২টি মানি লন্ডারিং মামলা করেছে এই তদন্তকারী সংস্থা।

দুদকও মাদক দমনে এগিয়ে এসেছে। তবে তা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। দুদক এখন পর্যন্ত দেড় হাজার মানি লন্ডারিং মামলা করলেও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে মাত্র দুটি মামলা করার তথ্য পাওয়া গেছে। সংস্থাটি শতাধিক কারবারির ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামলেও অগ্রগতি নেই।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন পাস হয়। ওই আইনে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে মামলা ও তদন্তের জন্য দুদককে একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আইনটি বাস্তবায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্ত নিয়ে পুলিশসহ কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হয়। যাছাই-বাছাই শেষে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

প্রকাশিত গেজেটে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১২ ধারায় সংশোধনী আনা হয়। এ ধারার উপধারা-১-এ বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন (সরকার কর্তৃক বিধি দ্বারা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের), অনুমোদন ব্যতীরেকে কোনো আদালত এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারার্থ আমলে গ্রহণ করবেন না।

শুধু তদন্ত নয়, মামলা দেখাশোনাও করত দুদক। তবে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুদুকসহ পাঁচটি সংস্থা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। দুদক ছাড়া অপর চারটি সংস্থা হলো- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এ পাঁচ তদন্ত সংস্থা এখন তিন শতাধিক মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, এর মধ্যে দুদকসহ চারটি প্রতিষ্ঠান তদন্ত শুরু করলেও মানি লন্ডারিংয়ের মামলার তদন্ত শুরুই করেনি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এজন্য দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট না থাকাকে দায়ী করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির অজুহাত, ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যোদ্ধা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সে যুদ্ধে আসলে কিছু হয় না। আমাদের জনবল ঘাটতি রয়েছে, এটা সবারই জানা। এর মধ্যে দক্ষ জনবলের সংখ্যা আরো কম। জনবলকে নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করার প্রক্রিয়াও বলা যায় নেই। যে কারণে আমরা সদিচ্ছা সত্ত্বেও মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত শুরু করতে পারিনি। তবে পাঁচ থেকে ছয়টি মামলায় সহযোগিতা করা হয়েছে।

মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযানও পরিচালিত হয়। জানা যায়, ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করতে বলা হয়। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে ১০২ জন এবং ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অনুসন্ধান করে এদের সবার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করা হবে বলে জানানো হয়।

সিআইডি ওই ১২৩ কারবারির মধ্যে ২০ জনের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে এখন পর্যন্ত ১৪টি মামলা করেছে। বাকিদের বিষয়ে নেই অনুসন্ধান কার্যক্রম। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি মামলা করার পর ৪০ জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে ডিএনসি। ১০২ কারবারিকে নিয়ে দুদকও অনুসন্ধান শুরু করেছিল। তবে কার্যক্রম এগোয়নি। সিআইডি ও ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, দায়ের করা মামলার তদন্তের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে।

তবে হাস্যকর ব্যাপার এই যে, আজ অবধি মানি লন্ডারিংয়ের প্রথম মামলার তদন্তই এখনো শেষ হয়নি। ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে বিশেষ অভিযান শুরু হলে ১১ জুন চট্টগ্রামের হালিশহর থানায় মাহমুদুল হাসান নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ১০ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করে ডিএনসি। এটিই সংস্থার প্রথম মানি লন্ডারিং মামলা। র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত শীর্ষ মাদক কারবারি জাহিদুল ইসলাম আলোর ইয়াবা কারবারের টাকা লেনদেন করে সরান মাহমুদুলÑএমন তথ্য থাকায় মামলাটির তদন্ত চলছে আজও।

একই ব্যক্তির মাদক কারবারের টাকা পাচারের অনুসন্ধানের সূত্রে ২০১৯ সালের ১ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানায় আরেকটি মামলা করে ডিএনসি। মাদক কারবারি আলো রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ইউসিবিএল ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে ১১ কোটি টাকা যাঁদের সঙ্গে লেনদেন করেছেন তাঁদের এই মামলায় আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন জাবেদ, তাঁর স্ত্রী ফারহানা সুমি, নূরুল ইসলাম মিঠু ও হাসান। তদন্তে আলোর সঙ্গে মিলে ইয়াবা কারবারের টাকা লেনদেনের আরো তথ্য মিলেছে বলে জানায় সূত্র।

সিআইডির অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্ত ইউনিট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থনৈতিক অপরাধের ২৬টি মামলা সিআইডির অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে আসে। এর মধ্যে দুদকের হাত ঘুরে আসে ১৬টি মামলা, যদিও মামলাগুলো ২০১২ ও ২০১৩ সালে দায়ের হওয়া। আর অর্থনৈতিক অপরাধ-সংক্রান্ত বাকি ১০টি মামলা আসে দেশের বিভিন্ন থানা হয়ে। সম্প্রতি এ মামলার সংখ্যা বেড়েছে। শুধু সিআইডি প্রায় দেড়শ’ মামলার তদন্ত করছে। বেশকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। মাদক ও মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের জন্য বড় অকল্যাণ অপেক্ষা করছে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাদক কারবারিদের প্রতিরোধ করতে শক্তিশালী আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris