শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তুমুল প্রতিযোগিতায় শহরেই বেশি বাড়ছে এজেন্ট ব্যাংকিং

Paris
Update : শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১

এফএনএস : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে চালু দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যাত্রা করে। কিন্তু দেশের গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকার বদলে শহরেই এজেন্ট ব্যাংকিং বেশি প্রসারিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওই আর্থিক সেবাটির বিস্তৃতিও বেশ সফলতা পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যেও চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। যেখানে ব্যবসা ও অর্থের প্রবাহ বেশি, সেখানেই খোলা হচ্ছে এজেন্ট আউটলেট। সেক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না আর্থিক সেবাটির আউটলেটগুলোর মধ্যকার দূরত্ব সংক্রান্ত রীতিনীতি। কোনো বাছবিচার না করেই ব্যাংকগুলো আর্থিক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে।

কিন্তু দারিদ্র্যপ্রবণ ও দুর্গম এলাকাগুলোয় এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। খোলা হচ্ছে না এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটও। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই ৬১০টি এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় চালু আউটলেটের সংখ্যা ৯৩। ঢাকা জেলায় সব মিলিয়ে আউটলেট রয়েছে ৯৭৭টি। চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে ৬৫০টি। অথচ দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা কুড়িগ্রাম জেলায় মাত্র ২২৪টি এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে। লালমনিরহাটে ওই সংখ্যা মাত্র ১২৪টি।

নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও পঞ্চগড়ে ১৩৯টি আউটলেট চালু হয়েছে। একই পরিস্থিতি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ ও পিছিয়ে পড়া জেলা সুনামগঞ্জেও। হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ জেলাটিতে এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে মাত্র ২১৭টি। অথচ শুধু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলাতেই বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১০৪টি। আর ইতিমধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় শতাধিক আউটলেট চালু হয়েছে।
সূত্র জানায়, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। ওসব ব্যাংকের ১৭ হাজার ৪৬৪টি এজেন্ট আউটলেট রয়েছে।

আউটলেটগুলোর মাধ্যমে মোট ১ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮টি হিসাব খোলা হয়েছে। তার মধ্যে নারীদের ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৯টি হিসাব। হিসাবগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। আর এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। দেশের এজেন্ট আউটলেটগুলোর মধ্যে ২ হাজার ১৯৯টি শহর এলাকায়, যা মোট আউটলেটের প্রায় ১৩ শতাংশ। বাকি ১৪ হাজার ৯৪৬টি গ্রামে। ওই হিসাবে এজেন্ট আউটলেটের ৮৭ শতাংশেরও বেশি গ্রামাঞ্চলে থাকার কথা। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামনের সারিতে রয়েছে দেশের তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা।

ওই তিন জেলায় ব্যাংকগুলোর চালু করা আউটলেটের সংখ্যা খুবই কম। তার মধ্যে বান্দরবানে সবচেয়ে কম আউটলেট রয়েছে। ওই জেলায় চালু করা আউটলেটের সংখ্যা মাত্র ৩৬টি। খাগড়াছড়িতে ৬৯টি ও রাঙামাটিতে ৭৩টি আউটলেট ব্যাংকগুলো চালু করেছে। সিলেট বিভাগের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা জেলা সুনামগঞ্জে আউটলেট চালু হয়েছে ২১৭টি। রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেশি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও ওই বিভাগের জেলাগুলো পিছিয়ে রয়েছে। ওই বিভাগের জেলাগুলোয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম আউটলেট চালু করেছে ব্যাংকগুলো। তার মধ্যে লালমনিরহাটে ১২৪টি, পঞ্চগড়ে ১৩৯, নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও কুড়িগ্রামে ২২৪টি এজেন্ট আউটলেট চালু হয়েছে। অথচ ৫টি পৌরসভা ও ৪৩টি ইউনিয়নের ফেনী জেলায় এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে ২৬১টি। ঢাকার পার্শ্ববর্তী দুই জেলা গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে চালু হওয়া এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৮ ও ২২৭।

সূত্র আরো জানায়, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলায় দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৬৬ শতাংশ ও ঋণের ৭৯ শতাংশ সীমাবদ্ধ। তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ব্যাংকঋণের ৬৩ শতাংশ। শুধু মতিঝিল ও গুলশান থানার ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ৪৫ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিটি থানায় বিভিন্ন ব্যাংকের প্রচুর শাখা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো থানা এলাকায় একই ব্যাংকের একাধিক শাখাও দেখা যায়। তারপরও খোদ রাজধানীতে ৬১০টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালু করা হয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও মূলত ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং পুরোপুরি ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

যেসব এলাকায় ব্যবসায়িক কর্মক্রম বেশি, ব্যাংকগুলো সেখানেই এজেন্ট দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। গ্রামাঞ্চলে বড় বাজারগুলোয় একই ভবনেই একাধিক ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট খোলা হচ্ছে। এতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আর্থিক সেবাটির সূচনা হয়েছিল তা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট সংখ্যা ও হিসাব খোলার দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তৃতীয় অবস্থানে এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার ৭০০টিরও বেশি আউটলেট চালু করেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয়। তারপর অন্যান্য ব্যাংকও দ্রুদ সময়ের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। তার মধ্যে ব্যাংক এশিয়া আউটলেট চালু ও ব্যাংক হিসাব খোলার দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষস্থানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ব্র্যাক ব্যাংকের শীর্ষস্থান। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, সরকার সামাজিক দায়বদ্ধতাকে প্রাধান্য দিলেও ব্যাংক যেকোনো কর্মসূচি নেয়ার আগে মুনাফার দিকটি বেশি দেখে। ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে যেসব এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং বিস্তৃত হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। আর্থিক অবস্থা খারাপ এলাকাগুলোতে নিয়োগ দেয়া এজেন্টরাও সফল হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো কোন এলাকায় কতটি এজেন্ট আউটলেট খুলতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সে বিষয়ে গাইডলাইন দেয়া আছে। আশা করা যায় এজেন্ট ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সেবার বিস্তৃতির মাধ্যমে দেশের সব জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার প্রচেষ্টা সফল হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris