শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পরপর ৪টি ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ৩ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১

এফএনএস : ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। একটি পরীক্ষায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্যরা ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রশ্নফাঁস চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ডিবি বলছে, ব্যাংকের পরপর চারটি নিয়োগ পরীক্ষায়ই প্রশ্নফাঁস করেছে চক্রটি। আর চক্রে জড়িত ও গ্রেপ্তারদের তিনজনই সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। ডিবির প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলোজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে।

এ পর্যন্ত চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি টাকা। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিবিপ্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার এসব তথ্য জানান। এর আগে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিম গত ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। এ বিশেষ অভিযানে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলামের নির্দেশনায় তেজগাঁও জোনাল টিমের টিম লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. শাহদাত হোসেনের নেতৃতে অভিযানটি পরিচালিত হয়।

গ্রেপ্তাররা হলেন- প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূলহোতা আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যায়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও পরীক্ষার্থী স্বপন। সংবাদ সম্মেলনে এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত পাঁচটি ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি অফিসার (ক্যাশ) শূন্যপদের নিয়োগ পরীক্ষা গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে ১৮৩টি, জনতা ব্যাংকে ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংকে ৫০০টি, রূপালী ব্যাংকে ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭টি পদ রয়েছে। বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানুল্লাহ ইউনির্ভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলোজি। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কাজ করতে থাকা ডিবির তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিমের কাছে গত ৫ নভেম্বর রাতে এই পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হবে- এমন তথ্য আসে। এরপর ডিবির টিম ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চক্রটিকে অগ্রিম টাকা দেওয়া হলে ওই চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপন (৩৬) পরীক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে যান।

এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। গত ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে যায়। এরপর স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনের তথ্যের ভিত্তিতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অভিযান চালানো হয়। তবে সেখান থেকে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামল ঢাকায় অবস্থান করছেন। পরে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে শামসুল হক শ্যামলকে (৩৪) গ্রেপ্তার করা হয়। শামসুল হক শ্যামলকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেন।

তার দেওয়া তথ্যে চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে (২৬) বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তারুজ্জামান আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলোজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান (হ্যার্ডওয়ার ও সফটওয়ার) হিসেবে কর্মরত আছেন। মুক্তারুজ্জামান আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালেয়ে কর্মরত অন্য সহযোগীদের সহায়তায় পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্য, তাদের মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্য যাচাই করা হয়। এর ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলানগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। ওইসব জায়গায় পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০-৩০ জন পরীক্ষার্থীর ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠান। মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামল জানান, সুকৌশলে তারা এরআগে আরও তিনটি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছেন। শ্যামন জানান, এই চক্র পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় দুই হাজার পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছেন। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।

এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নেওয়া হতো। মহানগর ডিবি প্রধান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথ ও এই চক্রের ২৫-৩০ জনের নাম এবং প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মোক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা। মোক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করেন। জানে আলম মিলন বিভিন্ন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করান। অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করান।

অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। স্বপন পরীক্ষার্থী। তিনিও প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থের বিনিময়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। এ পর্যন্ত এই চক্রের শনাক্ত সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন বলে জানা গেছ। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৩টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছিল বলে তথ্য মিলেছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই চক্রে আর যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান। অভিযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিন্তু আপনাদের অভিযানে প্রমাণিত হচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে এ নিযোগ পরীক্ষাসহ বিগত তিনটি পরীক্ষার নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের সুপারিশ ডিবি করবে কিনা জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানিয়েছি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris