শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জেল হত্যা দিবসে বিশেষ আয়োজন

Paris
Update : বুধবার, ৩ নভেম্বর, ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার : জেল হত্যা দিবসে বাংলাদেশে জুড়ে প্রতিবছর ভাবগাম্ভির্য ও সম্মানের সহিত ৩রা নভেম্বর পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের চারজন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং রাজশাহীর কৃতি সন্তান আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে জেলবন্দি অবস্থায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে গুলি করে মির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি স্মরণার্থে দৈনিক আমাদের রাজশাহী জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক ও পারিবারিক স্মৃতিচারনে বিশেষ ক্রোড়পত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াস করেছে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম
পরিচয় : সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম পুরুষ, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে। এই ঘটনাটি বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্ববাসীর সামনে গর্বিত পুনরুত্থানের সুযোগ করে দেয়। ১৬৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

জন্ম ও পারিবারিক জীবন : শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে কিশোরগঞ্জ জেলা সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নে বীরদামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাফিসা ইসলামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। ৪ ছেলে হচ্ছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, সৈয়দ শরিফুল ইসলাম ও সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম এবং ২ মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি, সৈয়দা রাফিয়া নূর।

শিক্ষাজীবন : সৈয়দ নজরুল ইসলামের লেখাপড়া শুরু যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল আর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে অতিবাহিত করেন তার স্কুল জীবন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দুই বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে বি.এ.(অনার্স), ১৯৪৭ সালে এম.এ এবং ১৯৫৩ সালে এল.এল.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৪৬-৪৭ সালে সলিমুলাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কর্মজীবন : বাংলা ১৩৮২ সনের ১লা বৈশাখ তারিখে ময়মনসিংহে স্থাপিত জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবার পরও সরকারি চাকুরী প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে আনন্দ মোহন কলেজে যোগদান করেন। পরে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।

রাজনৈতিক জীবন : পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির অন্যতম কর্ণধার। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথমে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০-১৩ মার্চ দু’দফা এ বৈঠক হয়। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা : শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ নামে একটি আদেশ জারি করেন। ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষা ছিল এই আদেশের উদ্দেশ্য।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ভূমিকা : শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে। নির্বাচনের পর পরবর্তী মন্ত্রিসভায় ও তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় সংসদে তিনি উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করলে তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২য় বারের মত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার শোকবহ সময়ে তিনি উপ- রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও হত্যাকারীদের জন্য রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে পারেননি।

মৃত্যু : শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাকে প্রথমে গৃহবন্দী এবং ২৩শে আগস্ট, ১৯৭৫ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয়। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যে দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ : তাজউদ্দীন আহমদ গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ২৩ জুলাই ১৯২৫ সালে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তিনি। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব¡ পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যা “মুজিবনগর সরকার” নামে অধিক পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হবার পর আরও তিনজন জাতীয় নেতাসহ তাকে বন্দী করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর বন্দী অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়। তার পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খান। স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তাদের ৪ সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি; মেজো মেয়ে লেখিকা ও কলামিস্ট এবং গাজীপুর-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আসীন অবস্থায় পদত্যাগ করেন।

শিক্ষাজীবন : তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু ভূলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। এরপর পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। তাজউদ্দীন আহমদ কোরআনে হাফেজ ছিলেন, যা তিনি নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সান্নিধ্যে আয়ত্ত করেন। তিনি ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান লাভ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. ডিগ্রীর জন্য পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন।

রাজনৈতিক জীবন : ১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে শেখ মুজিবের সাথে তিনিও যোগদান করেন। এই বছরের ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুণঃনির্বাচিত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা : নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় শেখ মুজিবের ডাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন। তাই তাজউদ্দীন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে মেহেরপুরের মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং পূর্ববাংলা সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন। সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দিন দেখেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই। মুক্তিফৌজ গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময় সাপেক্ষ কাজ। তিনি আরো বলেন যে ট্রেনিং বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না। কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন সাথে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি চলে আসার জন্য।

ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানি আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রিসভার সদস্য। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

স্বাধীন বাংলাদেশ : ২২শে ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাবেক ঢাকা-২০ আসন বর্তমান গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট প্রথম গৃহবন্দী ও পরে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাকে। সূত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী
পরিচয় : শহীদ মনসুর আলী সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের ‘কুড়িপাড়া’য় ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী, রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালে তিনি পি.এল জি’র ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হয়ে যশোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নেন। তখন থেকেই তিনি ‘ক্যাপ্টেন মনসুর’ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত বাংলাদেশ সরকারে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ফলে নিহত চার জাতীয় নেতার মধ্যে তিনিও একজন। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শহীদ মনসুর আলীর সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ নাসিম।

প্রাথমিক জীবন : বাবার নাম হরফ আলী সরকার। পড়াশোনা শুরু করেন কাজিপুরের গান্ধাইল হাই স্কুলে। এরপর চলে আসেন সিরাজগঞ্জ বি.এল. হাইস্কুলে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এখান থেকেই। এরপর চলে যান পাবনা। ভর্তি হন এডওয়ার্ড কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এই কলেজ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। এরপর ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে এখান থেকেই অর্থনীতিতে এম.এ এবং ‘ল’ পাস করেন। এল.এল.বি- তে প্রথম শ্রেণী লাভ তিনি। ১৯৫১ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন পাবনা জেলা আদালতে। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি। পাবনা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতিও ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক জীবন : আলীগড় থেকে দেশে ফেরার পর তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সাথে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিলেন পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি। ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং পিএলজি-এর ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিত হতে থাকেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচিত হন। কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেন, আব্দুর রব বগা মিঞা, জনাব আমিন উদ্দিন অ্যাডভোকেট প্রমুখের সাথে তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী-মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং পাবনা জেলা আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন এবং দলের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। শহরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এম. মনসুর আলী। ফলে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মনসুর আলী। এরপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে জারি হয় সামরিক শাসন। তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে কারা নির্যাতন ভোগের পর মুক্ত হন। বাঙালির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন। পাবনা-১ আসন থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতা যুদ্ধ : ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে মনসুর আলী গ্রেফতার এড়াতে চলে যান সোবহানবাগ কালোনীতে। এখান থেকে তিনি কেরানীগঞ্জ হয়ে কুড়িপাড়া যান তার পরিবারের সাথে দেখা করতে। এরপর চলে যান ভারতে। আসামের মাইনকার চর হয়ে তিনি কলকাতা গমন করেন। ভারতে আশ্রয় নেয়া অন্য নেতাদের সাথে দেখা ও যোগাযোগ হয় তার। এরপর দলীয় হাই কমান্ডের অন্য নেতারা মিলে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে গঠন করেন মুজিবনগর সরকার। নতুন গঠিত সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

স্বাধীনতা পরবর্তী ভূমিকা : ১৯৭২-এর জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে মন্ত্রী পরিষদ পুনর্গঠন করেন। এবার মনসুর আলী দায়িত্ব নেন প্রথমে যোগাযোগ ও পরে স্বরাষ্ট্র এবং যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মেরামতে রাখেন অগ্রমী ভূমিকা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে মনসুর আলী পুনরায় পাবনা-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) সাধারণ সম্পাদক হন তিনি।

এএইচএম কামারুজ্জামান
পরিচয় : বর্তমান নাটোর জেলার অন্তর্গত বাগাতিপাড়ার মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে ১৯২৩ সালের ২৬ জুন তারিখে এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল রাজশাহী শহরের কাদিরগঞ্জ মহল্লায়। তিনি বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা আবদুল হামিদ ও মাতা বেগম জেবুন্নিসা। ১২ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তার ডাকনাম ছিল হেনা। বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। একজন নির্লোভ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল দেশজুড়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে ঐ সময় কামারুজ্জামান সহ আরো তিন নেতাকে গ্রেফতার ও কারাবন্দী করা হয়। ঐ বছরেরই ৩ নভেম্বর ভোর সাড়ে চারটায় উক্ত কারাগারের অভ্যন্তরে তাকে সহ আরো তিন জাতীয় নেতাকে কিছু সেনা সদস্য নির্মমভাবে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম পাওয়া যায় এবং বিশেষ করে ডান দিকের পাঁজরে এবং ডান হাতের কনুইতে বড় রকমের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়। ঐ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।

পারিবারিক জীবন : ১৯৫১ সালে কামারুজ্জামান জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল গ্রামের আশরাফ্উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে। আশরাফ উদ্দিন তালুকদার ঐ অঞ্চলের জোতদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তিনি ৬ সন্তানের পিতা। তার বড় ছেলে এ এইচ এম খাইরুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় তফার বর্তমান মেয়র ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি। মেজো ছেলে এ.এইচ.এম. এহসানুজ্জামান স্বপন। মেয়েদের নাম ফেরদৌস মমতাজ পলি, দিলারা জুম্মা রিয়া, রওশন আক্তার রুমী ও কবিতা সুলতানা চুমকি।

শিক্ষাজীবন : কামারুজ্জামান হেনার লেখাপড়ার শুরু রাজশাহী শহরের কলেজিয়েট স্কুলে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের এক শিক্ষক ছিলেন তার ফুপা। তিনি রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে যাবার সময় কামারুজ্জামানকেও সাথে করে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা যান এবং বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করেন। রাজশাহী আইন কলেজ হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৫৬ সাল থেকে রাজশাহী জর্জকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

রাজনৈতিক জীবন : কামারুজ্জামান ছিলেন পারিবারিক ভাবে রাজনীতি সচেতন। তার দাদা হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার কংগ্রেস রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তবে ওহাবী আন্দোলনের সাথেও তার সম্পৃক্ততা ছিলো বলে জানা যায়। এ কারণে কংগ্রেস ও প্রথম সারির মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। হাজী লাল মোহাম্মদ দু’বার অবিভক্ত বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (এম.এল.সি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাজশাহী এসোসিয়েশন ও বরেন্দ্র একাডেমীর একমাত্র মুসলিম সদস্য ছিলেন। তার পিতা মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন রাজশাহী অঞ্চলের মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলাদেশ ও পরে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাই তার রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা : ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক হন ১৯৪২ সালে। তিনি ১৯৪৩-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র লীগের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন।

পাকিস্তান আমল : ১৯৫৬ সালে কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি দুবার মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৭ তিনি সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব খান সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে সারা দেশে অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। এমন সময় শেখ মুজিব পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেন। এই হাই কমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম নেতা ছিলেন কামারুজ্জামান।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকার্যে সরকারের অনীহা এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করাসহ আরো অন্যান্য কারণে বাঙালিদের মনে অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়। বাঙালিরা তখন শেখ মুজিবের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সরকার নিরীহ-নীরস্ত্র বাঙালি নিধনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়, যা ইতিহাসে অপারেশন সার্চলাইট ন নামে পরিচিত। এই কুখ্যাত গণহত্যার সময় পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি এর পূর্বেই তার দলের নেতা কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেছিলেন। জাতীয় চার নেতার সিদ্ধান্তে ১৯৭১ এর ১০ এপ্রিল গঠিত হয় প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এবং ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা বৈদ্যনাথ তলায় (পরবর্তীতে মুজিবনগর) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে। নবগঠিত মুজিবনগর সরকারে কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কামারুজ্জামান ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে তিনি মুক্তাঞ্চল, শরণার্থী শিবির ও সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করতেন।

যুদ্ধ পরবর্তীকালীন ভূমিকা : যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রীবর্গসহ স্বাধীন দেশে ফেরত আসেন। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে এলে সরকার পুনর্গঠিত হয়। সেই পুনর্গঠিত সরকারে তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাজশাহীর দু’টি সদর গোদাগাড়ি ও তানোর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করলে তিনি বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। সূত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে


আরোও অন্যান্য খবর
Paris