বৃহস্পতিবার

২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না

Paris
Update : মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

এফএনএস : পঞ্চাশ বছর বয়সী দেলোয়ার হোসেন রক্তের উচ্চচাপজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের লোকজন তাঁকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ওই হাসপাতালে আর যাওয়া হয়নি তাঁর। এর আগেই পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। রোববার চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর আঞ্চলিক সড়কের সদর উপজেলার চাদবিল ইম্প্যাক্ট হাসপাতালের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক এমন হত্যাকাণ্ড মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইরাক বা আফগানিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধে যে প্রাণহানি হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বিষয়টি যেন গা সওয়া হয়ে গেছে।

দেলোয়ার হোসেনের মত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আরও অনেকেই প্রতিদিন এভাবে অনিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে। একজন মানুষের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয় আরও অনেকের জীবন। ফলে এমন খামখেয়ালী সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বিপর্যয়ে পড়ছে প্রত্যহ অনেক পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতার পরও যান্ত্রিক যানের চালকরা নূন্যতম সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরলই বলা চলে। বরং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে।

চালকের অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, একজন যাত্রী ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কিনা অথবা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড শেষ করে নিরাপদে ফিরতে পারবেন কিনা এ নিয়ে প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত বছর সারা দেশে চার হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ছয় হাজার ৬৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে আরো আট হাজার ৬০০ জন। নভেল করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে লকডাউন চলাকালে দুই মাসের বেশি সময় রাস্তায় গণপরিবহণ না থাকার পরও ২০১৯ সালের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তিন শতাংশের বেশি। পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, গত ১৩ বছরে সড়কে ৫৯ হাজার ৯৪১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৮ হাজারের বেশি যাত্রী। উল্লিখিত সময়ে আহত হয়েছেন ২ লাখেরও বেশি যাত্রী। যেখানে একজন ব্যক্তির হতাহতের কারণে একাধিক পরিবারে নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেখানে এই বিপুলসংখ্যক আহত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

রাজধানীর একজন গাড়ির মালিক বিচক্ষণতার সঙ্গে গাড়ির চালক নিয়োগ প্রদান করেন। ফলে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা তুলনামূলক কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের শহরাঞ্চলে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানীতে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং অদক্ষ চালকের কারণে যে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে তাও বহুল আলোচিত। এ ছাড়া অন্য যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তাও অজানা নয়। চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক এটাই বড় প্রশ্ন। জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। ২০২০ সাল পার হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোনো কর্মপরিকল্পনা এখনো হয়নি। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

বেপরোয়া গতি, বিপদজনক ওভারটেকিং, ট্রাফিক আইন মেনে না চলা, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোসহ দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব জানান, গত বছর দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে এক হাজার ৩৯২ পথচারী, ১৫ সেনা সদস্য, ৫২ পুলিশ, ১৫ আনসার সদস্য, এক র‌্যাব সদস্য, দুই বিজিবি সদস্য, এক সিআইডি সদস্য, এক নৌ-বাহিনী সদস্য, এক বিমানবাহিনী সদস্য, পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পাঁচজন সাংবাদিক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৬৫৬ নারী, ৪১৮ শিশু রয়েছে এবং ৩৭৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ৩৯০ চালক ও ৩৫৫ পরিবহণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের বরাত দিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন পঙ্গুত্ব বরণ করে। বছরজুড়ে দুর্ঘটনায় মোট ছয় হাজার ৭৩৬টি যানবাহনের ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ বাস, ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান এবং ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ মোটরসাইকেল।

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সড়কে শৃঙ্খলা আনতে একটি কঠোর আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। তিন বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামলে বিষয়টি পুনরায় সামনে আসে। ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত একটি আইন সংসদে পাস করে। এরপর প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আইনটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে এখন আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনটি কার্যকরের আগেই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে।

এক. ২০১০ সাল থেকে আইনটি প্রণয়নে আট বছর ব্যয় করেছে সরকার। এর মধ্যে চারবার খসড়া করা হয়েছে। তাহলে কি শিক্ষার্থীদের খুশি করতে সরকার কঠোর আইনটি করেছে?
দুই. এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। কিন্তু সরকারের ওপর পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের চাপ আছে। তাই আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের মাধ্যমে তা শিথিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাহলে কি আইনের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা মূল লক্ষ্য নয়?
তিন. সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, বর্তমান আইনে কিছু কারিগরি ত্রুটি ও শাস্তির বিধান কঠিন হয়ে গেছে। এজন্য সংশোধন দরকার। তাহলে কি আট বছর ধরে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং বিশেষজ্ঞরা মিলে একটা পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের সক্ষমতার ঘাটতি আছে?
প্রয়োগে সময়ক্ষেপণের কারণে এমনিতেই আইনটি গতি হারিয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে যে আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল, সংশোধনের মাধ্যমে শাস্তি কমানোর উদ্যোগে তা-ও হারাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। প্রথমে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। পরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই আন্দোলন ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিন বছর পর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির চিত্র বদলায়নি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris